মেয়েটাকে নিয়ে স্বপ্নালু বাবা মা -
স্বর্ণলতা / বাঁশের পাতা
স্বর্ণলতার / বিয়ে হবে
জমিদারের / ঘরে।
স্বর্ণলতা বড় হয়। ঠিক যেন - ঝিঙেফুল। শেষ চিহ্নটা বিকেলের। সন্ধার সংকীর্ন সময়ের মতো। কেমন শান্ত্ম ঘরানার মন -
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢলঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল
ঝিঙ্গেফুল। (ঝিঙেফুল / কাজী নজরুল ইসলাম)
স্বর্ণলতা স্কুলে যায়। পড়বে। বিদুষী হবে। ওর স্বপ্ন সুলতানা রাজিয়া, তানিয়া, প্রীতিলতা, রোকেয়াদের মতো ...........। স্কুলে তার কতো পড়া। ওর পড়ায় ছন্দ, লিখায় ছন্দ। স্বাধীন বেড়ে ওঠা মেয়েটাকে নিয়ে আমরা ভাবছি, কতো ভাবনা। কিন্তু সমাজ ভাবছে - সমাজের কর্তামুখে বের হচ্ছে পদ ; ছড়ায় ছড়ায় -
মা গুনে / ঝি
গাই গুনে / ঘি।
স্বর্ণলতাকে তার মায়ের মত ভাগ্যটাকে মেনে নিতে হবে-
ঝি গুনে / জামাই,
পুত গুনে / কামাই।
কিন্তু মা যে পুরুষ শাসিত সমাজের শৃংখল ভাঙ্গতে চান। গেঁয়ো নিয়মচারিতা, সমাজের শৃংখল, ধর্মীয় অনুশাসন খেঁকিয়ে ওঠে-
ছেইরান (মেয়ে) / হইছে
আগালী ধান, /
কাঁচায় কুচায় / বাইন্ধা আন /।
২
এখনো নারীর দেহ মনকে কেবল উৎপাদন যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু ভাবা হয় না। নিয়ন্ত্রন রেখা তার চারপাশে। বিকেলের মাঠ ডাকে। খেলার ছলে কত ছড়ার ব্যবহার। স্বর্ণলতার চোখ বন্ধ। অন্য একজন পেছন থেকে চেপে ধরেছে চোখ। ডাকছে-
আয়রে আয় মরিচ ফুল
আয়না ধইরা হিতি (সিথি) তুল্।
মরিচ ফুলের মত সুন্দর একটা মেয়ে; আস্তে আস্তে এগোয়। চোখ বন্ধ যে মেয়েটার তার কপালে টোকা। আবার নিজের আসনে বসা। বিপক্ষের রাজার উচ্চারণ-
ক, খ, গ, ঘ, ঙ
মাথা হেট কর (মাথা নিচু কর)।
বইল্যা (বলে) দিলে খেলতাম না।
চোখ ছেড়ে দেয়া হল। কিন্তু স্বর্ণলতার চোখে যে অন্ধকার। ........... একসময় ফর্সা হয় চারপাশ। ওর কপালে যার টোকা পড়ল, ওটা কার টোকা?
বলা সম্ভব নয়। তবুও বলতে হয়। এ যেন ভাগ্যকেই বলা। ওদের জীবনটাতো এমনি। কার ঘরের আলো হবে স্বর্ণলতা? যার টোকাই পড়ুক কপালে .............।
লোকমুখের ছড়া গুলোতে স্বর্ণলতাদের জীবন বৈচিত্র গ্রন্থিত। দাদু স্বর্ণলতাকে দেখে দেখে ঠাট্টা করেন, ছড়া কাটেন-
কথায় / কথা বাড়ে
আহলাদে / ঝি বাড়ে।
বাবা- মার অস্বচ্ছলতার প্রেক্ষিতে স্বর্ণলতার বিয়ের এন্তেজাম হচ্ছে-
আমরার (আমাদের) / আবুরে (সন্তান) / বিয়া / দেয়াম (দেবো)
সামনের / শুক্কুর/ বারে (শুক্রবারে)
সন্দুক / ভইরা / বন্দুক / দেয়াম
ঠাস্ / ঠুস্ / করে
কোদাল / ভাইঙ্গা / নথ / দেয়াম
বাক্কা (চমৎকার) ঝুনঝুন / করে
আরছি (নারকেলের মালা) / ভইরা / মেরছি / (মিশ্রি) দেয়াম
দাঁতে / চিলিক (যন্ত্রনা) মারে।
এক / কুটরা (কৌটা) / হিন্দুর (সিঁদুর) / দেয়াম
কপাল / বাইয়া (বরাবর) / পড়ে।
ব্যাস্। স্বর্ণলতা স্কুল ছাড়ো। তুমি পড়ে কি করবে। পড়বে তো ছেলেরা। ওরা পড়বে, দেশে বিদেশে বড় হবে। দেশ চালাবে। তুমি মেয়ে মানুষ। বাপের মত বেটাই তো হবে রাজা-
গাছ গুনে / গুডা (ফল)
বাপ গুনে / ব্যাডা (ছেলে)।
৩
স্বর্ণলতার জন্য বিয়ের প্রস্তুতি। ওরই বান্ধবীরা সোৎসাহে নেমে পড়েছে-
ছুডু ছুডু (ছোট ছোট) আবু দুবাইন (ছেলে মেয়ে)
মেন্দি (মেহেদী) তুলাত্ (তুলতে) যায়,
মেন্দির ডাল্অ বাড়ি (আঘাত) খাইয়া
নাক ফুল ছুইট্যা যায়।
নাকফুলঅ ধইরা কইন্যা
পরের ঘরে যায়।
স্বর্ণলতা গাছ থেকে গাছে বেড়ায়। অন্যের উপর ভর করে চলা জীবন। ওখানেও যারা দাদী, নানী, চাচী, খালা, শাশুরী, ননদ, জা- সবাই তো স্বর্ণলতার মতই, নারী। ওদের চলমান জীবনের অংক নিয়ে তামাশা পুরুষের-
হোদ্দর (সহোদর) হোউরি / (শাশুরী) সেলাম পায় না
দাদী হউরী / পাও বাড়ায় (এগিয়ে দেয়)
নানী হউরী / চুলার পারঅ
বুত্বুতায়া / শইল খাউজ্জায় (চুলকায়)
স্বর্ণরলতার জা'য়েদের প্রতিদিনকার সূচীপত্র -
আত্তি (হাতি ) যায় গুড়া (ঘোড়া) যায়
ঝাড় জঙ্গল ভাইঙ্গা
বড় ভাবী ধান লাড়ে (নাড়াচাড়া করে)
মেতি ঘুমটা (এক ধরনের ঘোমটা) দিয়া
ছোট ভাবী বাঁশী বাজায়
এরে তারে লইয়া।
এখানে এসে স্বর্ণলতাও এক সময় মিশে যায় সবার সাথে। মনে হয় ধারাপাতের নামতার মতই। একটু এদিক ওদিক ফাঁক নেই -
শাশুড়ী : চিফুনিতে মই ( হয়ত স্বর্ণলতাকেই বলা হচ্ছে ) পিড়া (পিঁড়ি= ছোট একপ্রকার কাঠের আসন) আন্অ বই (বসি)
বউ : আঙ্গর দ্যাশ্অ পিড়া (পিঁড়ি) নাইগা (নেই)
বাঁশের মুথাত্ (খন্ড) বই।
শাশুড়ী : হাতি যায়রে গুড়া (ঘোড়া) যায়রে
নয়া সড়ক বাইন্দা
নয়া বউএ ধান মাপে
আশি গুন্ডা দিয়া।
৪
নতুন বউ স্বর্ণলতা। হাতি ঘোড়া যদি বাড়ীর পাশ দিয়ে সব কিছু ভেঙ্গে চলেও যায়, নতুন বউকে চুপচাপ বসে ধান মাপতে হবে। কোন কাট ছাট নেই। ওর উপরই সংসারের সমৃদ্ধি । এরকম সংস্কৃতিই চিরাচরিত। শশুড় শাশুড়ীর মন জুগিয়ে চলাটা তার নিয়তিকে মেনে চলার কসরৎ-
বউয়ের মুখ
বড় করে হোউরি (শাশুরী)
চুলার মুখ
বড় করে খড়ি (লাকড়ি)
সংসার টেনে টেনে স্বর্ণলতা ক্লান্ত । এখন স্বর্ণলতার কোলে সন্তান। মেয়ে সন্তান। সমাজ বলে- বংশরক্ষা হবে না।
কাজেই- লাউ লেংডি খেতা (কাঁথা)
যা করে বিধাতা।
অথবা
হাত নাই পাও নাই
চান মলেস্ন (মোড়ল)র বেওয়াই (বিয়াই)
স্বর্ণলতার নারী জীবন-সংসারের ছন্দ নেই। নেতিয়ে পড়া স্বর্ণলতার বিমর্ষ ছড়ার বিষন্ন গাঁথুনি-
নাচতাম চাই / নাচিনা
কোমর বিষে (ব্যাথায়) বাঁচিনা।
মনে পড়ে, নেত্রকোণার মেয়ে স্বর্ণলতা। মগরার নদীতে সাঁতরাতো।
বিকেলের মাঠে মেতে উঠেছে- রাজা ডাকছে স্বর্ণলতার দু'চোখ ধরে- আয়রে আয় মরিচ ফুল....................।।