আদিবাসী, আবার কখনো নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। ফলে এই নামকরণে যতখানি সমাজ, বৈজ্ঞানিক বা নৃ-তাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে তার বেশী পরিমাণে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিহিত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নামাকরনের ফলে আজ এ সব জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে পরিচয় বিভ্রাট দেখা দেয়। প্রায়শই এসব জনগোষ্ঠীর লোকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়- আদিবাসী না উপজাতি?
তবে শব্দ দুটির ব্যবহারের ফলে সমাজে বিরাজমান বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। ‘উপজাতি’ বা Tribe শব্দটি উদ্ভব হয়েছে ইউরোপিয় উপনিবেশিকতার উত্থান ও আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে জাতি-বর্ণ ভিত্তিক ভাবাদর্শ থেকে। উপনিবেশিকতাবাদের যখন খুব রমরমা অবস্থা, তখন কিছু জনগোষ্ঠীকে উপজাতি বা Tribe বলে আখ্যায়িত করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরও প্রভূত্বকারী জনগোষ্ঠী ও শাসকগোষ্ঠীর নিকট এ ব্যবহার আরো ব্যাপক মাত্রা লাভ করে । অধিনস্ত জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক বাবে প্রান্তিকীকরণের লক্ষেই শাসকগোষ্ঠীর নিকট এ শব্দটির উপযোগীতা বৃদ্ধি পায়। ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে মুক্ত জাতিরাষ্ট্রে এ শব্দটি এখনো ব্যপকভাবে রাজনৈতিক কাজে লাগানো হচ্ছে।
উপজাতি বলতে এমনসব বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও বিদ্বেষপ্রসূত। যেমন- লেখ্যরূপহীন ভাষা, সর্বপ্রাণবাদ,আদিমতা, পশ্চদপদতা, অসভ্য, ভবঘুরে, জীবন জীবিকাআদিম সমাজের মত, পশু-পাখি শিকার ও খাদ্য আহরণ,খাদ্যাভ্যাসে মাংসাশী, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন, মদ্যপান ও নৃত্যে আসক্তি, জংলীপনা সাপ-ব্যাঙ খাওয়া, পঁচা খাওয়া ইত্যাদি বিদ্বেষপ্রসূত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে উপজাতি বলে বুঝানো হয়ে থাকে। শুধু উপজাতি হিসাবে আখ্যায়িত কোন জনগোষ্ঠীই এই সব বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে একমত পোষন করে না। তাই নয়, এইসব
ইন্দ্রিয়বোধহীন মানদন্ড আসলে প্রভুত্ববিস্তারকারী জনগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থক
প্রতিষ্ঠানগুলোরই উগ্র জাতি-বর্ন বিদ্বেষী ভাবাদর্শকেই প্রতিফলন ঘটায় বলে
মনে করা হয়। তাই উপজাতি শব্দটি দিয়ে কখনোই আমরা কাউকে পরিচয় করাতে পারি না।
অন্যদিকে আভিধানিক ভাবে Indigenous কথাটির অর্থ হচ্ছে স্থানিয়ভাবে উদ্ভুত; এ অর্থে জন্মসূত্রে একটি দেশের নাগরিক এমন যে কেউ নিজে সে দেশের ওহফরমবহড়ঁং বাসিন্দা বলে দাবী করতে পারে। পৃথিবীর অনেক পূর্বসূরী বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে এসে বসতি গড়েছিল। এ অবস্থায় কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে Indigenous বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, তারাই নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের প্রাচীনতম অধিবাসীদের বংশধর।
ভাষা,সংস্কৃতি ও আত্ম পরিচয়ের বিচারে একজন গারো, হাজং, কোচ, চাকমা অবশ্যই বাঙালী নয়। তাদের পরিচয়ের স্বাতন্ত্রকে সাধারনভাবে বোঝানোর জন্য আদিবাসী, উপজাতি প্রভৃতি যে সব ডাক প্রচলিত- একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এগুলি Indigenous কথাটির প্রায় সমার্থক, যদিও বাংলা অভিধানগুলির অবজ্ঞাসূচক ব্যঞ্জনাও রয়েছে। যার ফলে অনেকের চোখে এগুলি আপত্তির। আভিধানিক অর্থে বাংলা ‘আদিবাসী’ ইংরেজী Indigenous দু’টোই পুরোপুরি সমার্থক।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে- কেবল আদিবাসী প্রাপ্ত বয়স্করাই নয়, আদিবাসী শিশুরাও নানা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে বলা যায় এই এলাকার কর্মজীবি আদিবাসী শিশুদের কথা, নেত্রকোণা সুসঙ্গ দুর্গাপুর সদরের কর্মজীবি আদিবাসী শিশুরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত। যেমন রোয়া লাগানো, ঢালাই, লাকরী / দুধ বিক্রি -প্রভৃতি কাজ করার পাশাপাশি এই শিশুরা স্কুলেও যায়, কিন্তু কর্মেক্ষেত্রে স্কুলে রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত তারাই লাঞ্চনার শিকার। কর্মজীবী আদিবাসী শিশুদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যনিম্নরুপ-
আদিবাসী না বলে-উপজাতী বললে শ্রমজীবী শিশুদের যা অনুভূত হয়- # উপজাতি বললে খারাপ লাগে/ নিজেদের আলাদা মনে হয় #উপজাতি বললে নিজেদের ছোট বা ক্ষুদ্র বলে মনে হয়/ মূল গাছ মনে হয় না,মনে হয় পরগাছা বা আগাছা।
কাজের জায়গায় শ্রমজীবি আদিবাসি শিশুদের সমস্যাঃ # মালিক অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়। # সময়ের চেয়ে অধিক কাজ করানো হয়, যেমন রোয়া লাগানো ও ঢালাইয়ের কাজে। # দোকানে জিনিস বিক্রি করতে গেলে সম্মান করে না, বাজে ব্যাবহার করে।
রাস্তাঘাটে কর্মজীবি শিশুদের আদিবাসী শিশুদের সমস্যাঃ # রাস্তাঘাটে নাক বোচা, মুখচেপ্টা বা অন্যভাবে তিরস্কার করে # আদিবাসী ভাষা নিয়ে তিরস্কার করে।
আদিবাসী কর্মজীবি শিশুদের স্কুলে সমস্যাঃ # সাধারনতঃ কাসের সামনের সারিতে বসা যায় না। # স্কুলে- অনুষ্ঠান/ প্রতিযোগীতায়/ খেলাধূলায় সমান সুযোগ পাওয়া যায় না।
সামাজিক সমস্যাঃ # আদিবাসী শিশুরা স্থানীয় ইউপি থেকে সঠিক তথ্য/সেবা পায় না # জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে নিজেদের উপজাতি পরিচয় দিলে ছোট মনে হয়।
জাতিসংঘের ঘোষনাকে সামনে রেখে Indigenous হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার যে দাবী বাংলাদেশের আদিবাসী কর্মজীবি শিশুরা জানাচ্ছে, সেটার অর্থ হলো নিজেদের স্বাতন্ত্র পরিচয় ও সংস্কৃতি নিয়ে এদেশের মাটিতে মানুষ হিসেবে বেচে থাকার অধিকারটুকু আমরা চাই। এরুপ উপলব্দি থেকেই আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সরকার ও সংগঠন উদ্যোগ নিচ্ছে। কারন আমরা বিশ্বাস করি, সব শিশু সমান।