নেত্রকোনার পালাগান - বিবিধ অনুষঙ্গের যৌথ শিল্পকলা

আনোয়ার হাসান : - ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চল মহুয়া-মলুয়ার দেশ, ভাটির দেশ নেত্রকোনা বিশ্বখ্যাত মৈমনসিংহ গীতিকার চারণ ভূমি নেত্রকোনাজারি, সারি, ভাটিয়ালি, পালাগান, কবিগান, বাউলগান, ঘাটুগান, গাইনেরগীত, ইত্যাদিতে নেত্রকোনা জনপদ এখনও মুখরিত হয় আবহমান বাংলার যে শাশ্বত রূপের চেতনা আমাদের মাথায় খেলা করে এর প্রবাহ নেত্রকোনার

ভাটিঅঞ্চলে (বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলেএখনো রহমান
 
জারি সারি ভাটিয়ালি এবং ছড়া প্রবাদ প্রবচন গুলো বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ, বাঙলার লোকমানুষের ঐতিহ্য, আবহমান বাঙলার সংস্কৃতির ভাষা এদের মধ্যে ছড়া অতি প্রাচীন, সবার চেয়ে বয়স্ক
অনুমান করতে দোষ নেই, জনমানুষের অন্তর্গত আবেগ, অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ প্রকল্পসমূহ প্রথম ভাষা পায় ছড়া প্রবাদ প্রবচনের পাশপাশি সব লোক গীতিকাগুলোর মাধ্যমে গুলোই হয়ে ওঠে প্রাচীন মানুষের শিক্ষা বিনোদনের মাধ্যমআমরা পর্যায়ক্রমে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পয়াস পাব

পালা গান
নেত্রকোনা পালাগান অসম্ভব জনপ্রিয় এবং বহুমাত্রিক গীতানুষ্ঠানযা নেত্রকোনা জনমানুষের একেবারে নিজস্ব স্টাইলের এক গীতিকলা এখানে গীত অভিনয় দুটোই মুখ্য, একটা ছাড়া অন্যটা অচলরূপকথার আঙ্গিকে কাহিনীর বিন্যাস অত্যন্ত চমকার কাহিনী এগিয়ে যায় নানা ডাল-পালায়সাধারণত স্থানীয় কিংবদন্তীকে ধরেই পালার কাহিনী গড়ে ওঠেকখনো রাজা-বাদশা, উজির-নাজির,শাহজাদা-শাহজাদী বা রাজকুমার-রাজকুমারীর চটকদার কাহিনীর বুনোটেও পালাগানের অবয়ব বিকশিত হয়
পালাগানের গায়কীতে অভিনয়ের পাশাপাশি নৃত্যকলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নৃত্য এখানে সুশৃঙখল মুদ্রাভিত্তিক  নাচের কোন জলসা নয় বরং গল্পের বিবরণকে হৃদয়গ্রাহী, আকর্ষনীয় এবং স্পষ্ট করার জন্য যতটুকু অঙ্গভঙ্গির প্রয়োজন হয়, ততটুকুই
যাকে কেন্দ্র করে বা যিনি গীতিময় নৃত্য সম্বৃদ্ধ অভিনয় কলার প্রদর্শন করেন বা লোক সম্মুকে সুরেলা বয়ান উপস্থাপন করেন তাকে স্থানীয় ভাষায় বয়াতি বা গীতালু বলা হয়ে থাকেতার সাথে সঙ্গত করার জন্য কমপক্ষে তিনজন ব্যাক্তি বাদ্যযন্ত্র ( খোল, কর্তাল, হারমুনিয়াম, বাঁশি ইত্যাদি) নিয়ে মঞ্চের একপাশে অবস্থান করে
বয়াতির অবশ্যই লম্বা চুল থাকবে,আর গায়ে থাকবে চটকদার রঙিন পোষাক ওড়নার মত একচিলতে কাপড় এবং বালিশ অবশ্যই থাকবেওড়নার মত কাপড়টি মাথায় ঘোমটা বানিয়ে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করছে, কখনো বা মাথায় পাগড়ি বা কোমরে গামছার মত বেঁধে পুরুষের অভিনয় করছে অর্থা গল্পের প্রয়োজনে নারী, পুরুষ, রাজা, উজির, বনিক, মাঝি ইত্যাদিসহ সর্বস্তরেরর মানুষের চরিত্রে অভিনয় তো করেই, এমন কী পুশু-পাখিসহ সর্বস্তরের প্রাণীর চরিত্রেও অভিনয় করে থাকে শুধু তাই না, কাহিনীর বিবরণে উল্লেখিত কোন জড় বস্তুও বাদ যায় না বিভিন্ন সিকোয়েন্স প্রকাশ করতে সিথানের সাধারণ বালিশটি বয়াতির নিপুন কৌশলে জীবন্ত হয়ে ওঠে বালিশের ব্যবহারটা এত অধিক যে কখনো মনে হতে পারে, বালিশ ছাড়া পালাগানের অনুষ্ঠান একেবারেই অচল
একটি মানুষ সঙ্গীত নৃত্যের পাশাপাশি একাধারে সর্বস্তরের অভিনয় কী করে করতে পারে বিস্ময় সেখানেইবাস্তবে পালাগানের অনুষ্ঠান স্বচক্ষে না দেখলে তাকে বুঝানো কঠিনযারা কদ্দুছ বয়াতির পালাগানের অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছেন টেলিভিশনে বা মঞ্চে, তারা অবশ্যই অনুমান করতে পারবেন বিষয়টা গ্রামের সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিতে এদের জুড়ি নেই
আনন্দের পাশাপাশি বয়াতিগণ সেই সমাজের মূল্যবোধ থেকে আহরিত কিছু নীতিকথাও প্রচার করে থাকেগ্রামের নিরক্ষর মানুষেরা সুরের তালে তালে সেইসব নীতি কথাগুলোকে জীবন পথের পাথেয় হিসাবে বিবেচনা করে থাকে

যেমন,
একজাইত্যা নারী আছে
পায়ের গোছা মোডা
সেই নারীরে বিয়া করলে
বংশে থাকে খোঁডা
আরেক জাইত্যা নারী আছে………………..
ইত্যাদি ধরনের সুরেলা গাঁথার মাধ্যমে নারী-পুরুষের বিবিধ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়
মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলো ছাড়াও নেত্রকোণা অঞ্চলে আরো বহু পালার অস্থিত্ব আছে যেগুলো স্থানীয় বয়াতিদের দ্বারা গীত হয়
যেমন,
হাসনকুলির পালা,রয়নার গীত ইত্যাদি পালার শুরুতেই  বন্দনা থাকে

যেমন,
পূবেতে বন্দনা করি পূবের ভানুশ্বর
এক দিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর
দক্ষিণে বন্দনা গো করলাম ক্ষীর-নদী সাগর।।
যেখানে বানিজজি করে চান্দ সওদাগর
উত্তরে বন্দনা গো করলাম কলৈশ পর্বত
পশ্চিমে যেখানে পড়িয়া অছে আলীর, মালামের পাথ্থর
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান
উরদিশে বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান
সভা কইরা বইছ ভাইরে হিন্দু মুসলমান
……………………………

(মৈমনসিংহ গীতিকা)
এরকম নানা ভাবে রসে বয়াতিগণ পালার শুরুতে বন্দনা করে থাকেনপালা উপভোগ করেন যে সামাজিকগণ তাদেরকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সম্মান জানানোর রেওয়াজ সর্বজন বিদিত হিন্দু-মুসলিম দুটি ধর্মীয় বিশ্বাসকে এক সাথে গ্রন্থিবদ্ধ করার সাহস ঔদার্য একজন নিরক্ষর গ্রামীণ বয়াতির পক্ষে কল্পনা করতে গিয়ে বিস্মিত হতে হয়তবে অবশ্যই পালাসমূহের যে সমাজে, সেই সমাজের সামাজিক দর্শনের প্রতিফলন বয়াতির রচনায় ঘটবে বা উঠে আসবে এটাই স্বাভাবিক
এখানে বয়াতি সম্পর্কিত ধারাণাটা পরিস্কার হওয়া বাঞ্চনীয় বয়াতি শব্দটি আঞ্চলিক যা,আরবি শব্দ বয়ান বা  বয়েত থেকে এসেছে বলে অনুমান করা হয়বয়ান শব্দের অর্থ বিবরণ, বর্ণনাআর বয়েত শব্দের অর্থ,কবিতাংশ, দুই চরণের কবিতাপালাগানের বয়াতি শব্দটি উল্লেখিত দুটি অর্থই বহন করে থাকেযিনি পালা নিজে সৃস্টি করেন না বা করতে পারেন না,শুধু গাইতে পারেন জীবিকার জন্যেই হোক আর সখের বসেই হোক বয়ানকারী অর্থে তিনি বয়াতি আবার যিনি পালা সৃস্টি করেছেন,বা করেন, আবার চারণ কবি হিসেবে গেয়েও থাকেন, তিনি বয়েত এবং বয়ান উভয় অর্থেই বয়াতি
তবে পালাসমূহ কে প্রথম সৃষ্টি করেছেন বলা মুসকিল এগুলো আসলে জনমানুষের সৃস্টি কারণ এগূলো অনেক মানুষের মুখে মুখে বয়ান হয়ে এসেছেএগুলোকে সময়ে সময়ে বয়াতিগণের নিজ নিজ প্রতিভার শক্তি অনুসারে সংযোজন বিয়োজন বা সাজিয়ে নিয়েছেন বয়াতিগণের প্রতিভার শক্তি-মত্তা এবং অনেক সময় বিশাল জনপ্রিয়তার জন্যও কারো কারো পক্ষে কোন পালার স্রষ্টা বনে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়তবে কিংবদন্তী কিংবা রূপকথাগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে (গীত বাইন্ধা)কোন কোন প্রতিভাবান বয়াতি স্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ তো হয়েছেন তা অস্বীকার করার উপায় নেইযেমন মৈমনসিংহ গীতিকার দ্বিজ কানাই, মনসুর বয়াতির নাম উল্লেখ করা যায়মূল রচয়িতার নাম নিয়ে বহু বিভ্রান্তিও আছে মহুয়ার পালার ব্যপারে দীনেশ চন্দ্র নিজেই উল্লেখ করেছেন,’গীতিকার প্রথম ১৬ ছত্র জনৈক মুসলমান গায়কের রচিত
বয়াতির প্রতিশব্দ হিসেবে গীতালু শব্দটিও চালু আছে সভ্য ভাষায আমরা যাকে গান বলি  গীত মূলত তাই কিন্তু নেত্রকোণা গ্রামীণ মানুষের কাছে গীত হলো-বিভিন্ন বিয়ে-সাধী বা সব অনুষ্ঠানে মহিলারা দল বেঁধে যে সঙ্গীত পরিবেশন করে তাই ধারণাটা বর্তমানকালের হয়ত পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ নিরক্ষর মহিলাদের প্রাচীন ধারার এই সঙ্গীতকে বর্তমান সভ্য সমাজের সঙ্গীতের সাথে একটা পার্থক্য নির্ধারণ করার জন্যই এমন ধারণার জন্ম হতে পারে পালাগান গায় যে বয়াতিগণ তাদেরকেও হয়ত একই বিবেচনায় গীতালু বলা হয়নেত্রকোনার যে অঞ্চলে গীতালু শব্দটা চালু আছে, সে অঞ্চলে পালাগানকে বলা হয় লম্বাগীত
পালাগান গুলোকে আবার ‌ ‌‌‘কিচ্ছা বলা হয় নেত্রকেণাপালা পাশাপাশিকিচ্ছানামটা ব্যাপকভাবে পরিচিত আমি একজন জনপ্রিয় বয়াতির কথা জানি যার পরিবেশিত কিচ্ছা তার গ্রামের নামানুসারে পরিচিতি লাভ করেছিল-মেডুল্লার কিচ্ছা তার গ্রামের নামের সাথে তার নিজের নামটিও জড়িয়ে গিয়েছিল মেডুল্লার শহরালির কিচ্ছা এখানে মেডুল্লা গ্রামের নাম এবং শহরালি তার নিজের নামতার বৃদ্ধ বয়সে পরিবেশিত এক অনুষ্ঠান উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন আমি বেশ ছোট কাহিনীর ডাল-পালাসহ পরিবেশনা এমন উপভোগ্য হয়েছিল যে, আমি উঠি উঠি করেও শেষ না করে উঠতে পারছিলাম না সেদিন

লেখক : অধ্যাপক আনোয়ার হাসান ।
 
Design by নেত্রকোনার আলো | সম্পাদক - সোহেল রেজা | Email-netrakonaralo@gmail.com