গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষে লড়াই

-----------সঞ্জয় সরকার
নেত্রকোনার আলো ডট কম : এক সময় জমিদারদের নির্দেশে বাধ্যতামূলকভাবে বুনোহাতি ধরতে হতো গারো পাহাড় অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী হাজংদেরমুর্শিদাবাদ, আগ্রা, দিল্লিসহ বিভিন্ন জায়গায় এসব হাতি বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন জমিদাররাঅন্যদিকে, খেদা (ফাঁদ) দিয়ে হাতি ধরতে গিয়ে মারা যেতেন প্রজারাপ্রাণভয়ে কেউ হাতি ধরতে অস্বীকৃতি জানালে শিকার হতেন জমিদারবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের জমিদারদের
এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক সময় আন্দোলন গড়ে তোলেন হাজং সম্প্রদায় দীর্ঘ ৫ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৮৮৪ সালে সরকার বাধ্য হয় হাতিখেদা আইন তুলে নিতেউনিশ শতকের এ বিদ্রোহ ইতিহাসে হাতিখেদা বিদ্রোহবাহাতিখেদা বিরোধী আন্দোলননামে পরিচিত

হাতিখেদা আইন রহিতকরণের ফলে পাহাড়ের হাজংরা খেদা দিয়ে বুনো হাতি ধরার অমানবিক নির্দেশ থেকে মুক্ত হয়কিন্তু বুনোহাতির তাণ্ডব থেকে তাদের মুক্তি মিলেনি আজো

গা শিউরে ওঠা ঘটনা : সন্ধ্যা নামলেই মংমা (হাতি) আসেবাড়িঘর তছনছ করেভয়ে ঘুমাতে পারি নাআতঙ্কে রাত পার করিকথাগুলো শান্তিলতা নকরেকের শান্তিলতার বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার গোপালপুরেতার বাড়ির মাত্র ৩শ গজ দূরে মেঘালয়ের গারো পাহাড়দিনের বেলা হাতিগুলো পাহাড়ে বিচরণ করে রাতে ধান, কচি বাঁশ, কাঁঠাল, আনারস এবং নারকেল, ঝাউ ও কলাগাছ খাওয়ার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের ঢালু পথ দিয়ে নেমে আসে লোকালয়েশান্তিলতা জানান, ‘মানুষের আঁচ পেলে হাতি আরো হিংস্র হয়ে ওঠেতেড়ে আসেএদের সঙ্গে দৌড়েও পারা যায় নাশুধু গোপালপুরেই নয়, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, শেরপুরের নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি, শ্রীবরদী, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার অন্তত ৫০টি সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামে প্রায় সময় চলে বুনোহাতির তাণ্ডবসাধারণত ধান পাকার মওসুম থেকে হাতির উপদ্রব শুরু হয়এর পর দু-তিন মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকেপ্রায় রাতেই হাতির দল হানা দিচ্ছে সীমান্তের গ্রামগুলোতেআবার রাত পোহাবার আগেই ফিরে যাচ্ছে ভারতের সীমানায় অবস্থিত গহিন পাহাড়গুলোতে

গোপালপুর গ্রামের জিতু রেমা জানান, খাবারের সন্ধানে আসা বুনোহাতির দল পাহাড় ঘেঁষা গ্রামগুলোতে রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেকদিন আগে একদল বুনোহাতি তার একটি ধান ক্ষেত সম্পূর্ণভাবে গুঁড়িয়ে দেয়এর দুদিন পর ভেঙে চুরমার করে দেয় শাকিলা দিও নামে এক গারো মহিলার গোয়াল ও রান্নাঘরযাবার সময় তার বাড়ির কাছের টিলার নিচের একটি প্রকাণ্ড ঝাউ গাছও গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়গোপালপুরের পার্শ্ববর্তী বাদামবাড়ি, ফান্দা, মেনকি ফান্দা, ভরতপুর এবং বারমারি গ্রামেও তাণ্ডব চালাচ্ছে বুনোহাতিএকই গ্রামের ওয়াশিংটন মারাক জানালেন, গত কয়েক বছরে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে এ এলাকার তিনজন মারা গেছেনএরা হচ্ছেন ফান্দার অবিনাশ, গোপালপুরের রহমনি ও মাহাদিআহত হয়েছেন আরো অনেকে

এদিকে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি এবং শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতেও বেশ কিছুদিন ধরে চলছে ভয়াবহ হাতি আতঙ্ক এরই মধ্যে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন দুজনঅনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৯ জুন ভোর রাতে ৪০-৫০টি বুনোহাতি হানা দেয় নালিতাবাড়ির মায়াঘাসি গ্রামে তাণ্ডব থেকে বাঁচতে ৭০-৮০ জন গ্রামবাসী মশাল জ্বেলে ধাওয়া করে হাতিগুলোকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলে হাতি-মানুষের লড়াইএ সময় একটি ক্ষুধার্ত হাতি ক্ষিপ্ত হয়ে জয়নাল আবেদীন (৪০) নামের একজনকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে শূন্যে তুলে আছাড় মেরে ফেলেএর পাঁচদিন আগে (৪ জুন) পাহাড় থেকে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঝিনাইগাতির ছোট গজনী এলাকায় মারা যান ফুলহারি গ্রামের সোহরাব আলী (৫০) একইভাবে গত বছরের ১০ অক্টোবর হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান শ্রীবরদীর হালুয়াটি গ্রামের আমিনুল ইসলাম (২৮) ও ফারুক আহমেদ মিস্টার (৩৬) নামে আরো দুজন

গত ১৩ জুন সন্ধ্যার পর থেকে ভোররাত পর্যন্ত নালিতাবাড়ি উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের তাড়ানী গ্রামে ৩৫-৪০টি বুনোহাতি ভয়াবহ তাণ্ডব চালায়ক্ষুধার্ত হাতিগুলো লণ্ডভণ্ড করে দেয় গ্রামের ফ্লরেন্স সাংমার তিনটি, ব্রত রিছিলের দুটি, ব্রজাবালা চাম্বুগংয়ের দুটি, জীতেন্দ্র খকশীর দুটি, বার্নাড সাংমার একটি ও মুকুল মানখিনের একটি ঘরদেখে মনে হয় বাড়িগুলোর ওপর দিয়ে প্রচণ্ড টর্নেডো বয়ে গেছেএ সময় গ্রামের শত শত মানুষ দৌড়ে স্থানীয় পানিহাটা পাদ্রি মিশনে আশ্রয় নেয়এ তো গেল হাতির তাণ্ডবের কয়েকটি উদাহরণ মাত্রশেরপুরের নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি, শ্রীবরদী, জামালপুরের বকশীগঞ্জ, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দার ৫০টির বেশি পাহাড়ি গ্রামে প্রায়ই হানা দেয় বুনোহাতির দলচালায় ধ্বংসযজ্ঞগুঁড়িয়ে দেয় বাড়িঘর, ফসলগত ১০ বছরে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে এসব এলাকার অন্তত ৩০ জন মারা গেছেআহত হয়েছে অনেক মানুষধ্বংস হয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি, গাছপালা ও ক্ষেতের ফসল

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সীমান্ত এলাকায় ভারত সরকার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ফলে হাতি আগের মতো অবাধে বিচরণ করতে পারে নাএছাড়া বেড়া নির্মাণের পর শেরপুরের সীমান্ত এলাকায় কিছু হাতি আটকাও পড়েছেএসব হাতি দিনে পাহাড়ের টিলাগুলোয় বিচরণ করে রাতে চলে আসে লোকালয়েঅন্যদিকে পাহাড়ের বন জঙ্গল ধ্বংস হয়ে খাবারের সঙ্কট সৃষ্টি এবং পানির উস কমে যাওয়ার কারণেও সন্ধ্যার পরে এসব হাতি দল বেঁধে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে

জীবন-সম্পদ রক্ষার লড়াই : হাতির উপদ্রব শুরু হলেই সংগঠিত হতে হয় গারো পাহাড়ের বাসিন্দাদেররাত জেগে ঘরবাড়ি পাহারা দিতে হয়হাতি সাধারণত আলো বা আগুনের গোলা দেখে এবং বাদ্য-বাজনা শুনে ভয় পায়এ জন্য উপদ্রুতরা সনাতন পদ্ধতিতে টর্চ, মশাল বা ভোগাবাতি জ্বেলে বাদ্য-বাজনা পিটিয়ে ও হৈ-হুল্লোড় করে হাতির উপদ্রব কমানোর চেষ্টা করেনএতে কিছুটা কাজও হয়কিন্তু বিপদের সম্ভাবনা থাকেদৌড়ের মুখে হাতি কখনো কখনো ক্ষেপে গিয়ে মারমুখী হয়ে ওঠেদলে বাচ্চা হাতি থাকলে এরা বেশি আক্রমণাত্মক হয়তখন আর কোনো বাধাই মানতে চায় নাপাল্টা আক্রমণ করতে তেড়ে আসেকিন্তু এরপরও যুগ যুগ ধরে এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাতি তাড়ানোর কসরত করছেন পাহাড়-গাঁয়ের বাসিন্দারাএ প্রসঙ্গে নালিতাবাড়ির মায়াঘাসি গ্রামের আবদুল জলিল জানান, ‘বন্যহাতি এখন আর আগের মতো মশাল দেখে বা চিকার শুনে ভয় পায় নামাঝে মাঝে প্রচণ্ড ক্ষেপে ওঠে
হাতি নিয়ে মাতামাতি : হাতির তাণ্ডব শুরু হলে উপদ্রুত গ্রামগুলোতে ছুটে যান জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরাঅনেকে নানা প্রতিশ্রুতি শোনান ক্ষতিগ্রস্তদেরকিন্তু গত কয়েক দশক ধরে অব্যাহতভাবে দেয়া এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটাই তেমন আলোর মুখ দেখেনি
সর্বশেষ গত বছরের জুন মাসে সরকারের এক মন্ত্রী শেরপুরের গজনী এলাকা পরিদর্শনে এসে হাতি-মানুষের সহাবস্থানের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি, সীমান্ত এলাকায় হাতির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেনকিন্তু ওই প্রতিশ্রুতিরও কোনো বাস্তবায়ন হয়নি আজো

ভুক্তভোগীদের দাবি : বুনোহাতির তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেতে এলাকাবাসী একাধিকবার মানববন্ধন করেছেপ্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেকিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয়নিনালিতাবাড়ি ও ঝিনাইগাতির গ্রামগুলোতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে কিছু টর্চলাইট, কেরোসিন এবং হারিকেন সরবরাহ করা হয়কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেই সামান্য
নালিতাবাড়ির রামচন্দ্রকুড়া ইউপির চেয়ারম্যান আমানউল্লাহ বাদশা বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিতহাতির সঙ্গে এসব গ্রামের মানুষের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়গ্রামগুলো বিদ্যুতায়িত হলে বুনোহাতির তাণ্ডব অনেকটাই কমবে দুর্গাপুরের সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহীনুর আলম চৌধুরীও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেনতবে এলাকাবাসী আরো জানান, শুধু বিদ্যুতের আলোতেই সমস্যার হয়তো স্থায়ী সমাধান হবে নাসীমান্ত এলাকায় হাতির খাবারের উপযোগী পর্যাপ্ত গাছ লাগাতে হবেলোকালয়ে আসার পথ বন্ধ করতে হবেদুদেশের যৌথ উদ্যোগে অভয়াশ্রম তৈরি করেও এ উপদ্রব কমানো যেতে পারে
 
Design by নেত্রকোনার আলো | সম্পাদক - সোহেল রেজা | Email-netrakonaralo@gmail.com