কোন কোন বাড়ীর একটা বিশেষ নামে এলাকা ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিচিতি লাভ করে। তখন যদি কেউ প্রশ্ন করে বাড়ী কোথায়?
উত্তর : রহিমপুর।
পাল্টা প্রশ্ন : রহিমপুর কোন বাড়ী?
উত্তর : রহিমপুরে ডাকাতবাড়ী।
উত্তরটা শুনে একটু চোখ বড় বড় তাকান প্রশ্নকারী। একটু ঢোগ গিলেন।
ও বাড়ীতে কেউ কি ডাকাত ছিল কোনকালে ? পাল্টা প্রশ্ন আসে ওদিক থেকেও।
ও বাড়ীতে কেউ কি ডাকাত ছিল কোনকালে ? পাল্টা প্রশ্ন আসে ওদিক থেকেও।
ভাইজান, আপনের বাড়ী?
আমার বাড়ী দয়াগঞ্জ।
দয়াগঞ্জ কোন বাড়ী?
দয়াগঞ্জের ব্যারিস্টারবাড়ী।
উত্তরদাতার একটু গর্বগর্ব ভাব।
দুবাড়ীর কেউ ‘ডাকাত’ কিংবা ‘ব্যারিস্টার’ ছিলো কিনা এনিয়ে কোন ডকুমেন্ট নেই। এ বিষয়ে কথা বললে লোকজন বলেন- শুনছি অমুক আর তমুক......। গল্প এভাবেই চলে। কোদালিয়া এরকম আরো দুটি বাড়ীর গল্প। গ্রামের দুটি বাড়ী- ডিস্কো বাড়ী আর মেমবাড়ী।
দুটোরই বুৎপত্তিগত আলোচনা গ্রামবাসীর মুখে যথেষ্ট। ডিসকো পোশাক তখন শহর পর্যন্ত এসেছে। এবাড়ীর কেউ একজন একদিন ঢোলা বড় শার্ট আর নীচে স্কিনটাইট জিন্স, পায়ে স্কেটস, হাতে ক্যাসিও ঘড়ি পড়ে গ্রামে এ বাড়ীতে এসেছিল। কিভাবে যেন তা ছড়িয়ে গেল- ডিসকোবাড়ী।
ওদিকে যে বাড়ীর সবগুলো মেয়েই বোরখা পড়ে, ওদের বিয়ে হয় আলেম ওলামা, মৌলভী বেছে বেছে, তাদেরই এক মেয়ের বিয়ে হল কাকতালীয়ভাবে সিঙ্গাপুর প্রবাসী এক তরুণের সাথে। ওরা সিঙ্গাপুর গেল। দশ বছর পর ফিরল মেম হয়ে। মৌলভী বাড়ীর মেয়ের পরনে পেন্টশার্ট, মাথার চুল কম। ভেড়ার মত চুলঅলা সাদা ফুরফুরে তিনটে বাচ্চা কোলে।
ব্যস হয়ে গেল মেম বাড়ী।
তবে দুটো বাড়ীর মধ্যে অনির্দিষ্ট একটা সময় যাবৎ ঠুকোঠুকি আর পাল্টাপাল্টি। গ্রামে খেলা হবে- ওদের উত্তেজনায় বিভক্তি, গ্রামেও ওদের পক্ষ নিতে গিয়ে বিভক্তি।
ডিসকোবাড়ীর মেয়ের বাচ্চা হয়েছে হাসপাতালে। তো মেম বাড়ীর ছেলের বউ ভর্তি হবে ক্লিনিকে।
মেমবাড়ীর মেয়েটার বিয়েতে জবাই হয়েছে ছেচল্লিশটা খাশী। ডিসকোবাড়ীর ছেলের বিয়েতে জবাই হবে আটচল্লিশটা।
ডিসকো বাড়ীতে বিল্ডিং উঠলো তিনতলা। মেম বাড়ীর লোকজন উঠালো চারতলা এবং দুটো।
মেমবাড়ী কিনে ফেলেছে মটর বাইক, ডিসকোবাড়ীরা ওইদিন বিকেলেই মাইক্রো কিনে ফিরলো।
একবার একটা স্কুলে দুবাড়ীর দুটো ছাত্র ছাত্রী একজন মেয়ে আরেকজন ছেলে। প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষায় সিট পড়েছে কোদালিয়া গ্রামের হাজী বশির স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
হাজী বশির নামে এখানে একজন লোক থাকতেন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অখ্যাত একবাড়ীতে। ভাল টাকা পয়সার মালিক। তিনি করে গেছেন স্কুলটা। ওখানেই পরীক্ষা দিচ্ছে ছাত্রছাত্রী। সিট পড়েছে একজন আগে একজন পরে।
ছাত্রছাত্রী দুটোর মধ্যে প্রতিক্রিয়া তেমন দেখা যায়নি। সমস্যাটা বাঁধলো ডিসকোবাড়ী বনাম মেমবাড়ীর বড়রা। দুটো সিট আগেপড়ে- এ ধরনের অবস্থানটা কারো কাছে গ্রহনযোগ্য হচ্ছে না।
শুরু হলো বাক বিতন্ডা, হাতাহাতি, মারামারি। গ্রামবাসীও দ্বিধাবিভক্ত। স্কুলের পরিদর্শক, পরীক্ষা পরিচালনা পর্ষদ, টিচারদের কেউ সুরাহা দিতে পারছেন না। অতঃপর পুলিশ এনে পরীক্ষাটা শেষ হয়েছে কোনমতে।
ফলাফল- সে বছর স্কুলের কোন ছাত্রছাত্রী বৃত্তি পায়নি।
এনিয়েও দফায় দফায় বাকযুদ্ধ, মল্লযুদ্ধ, ঘুষি প্রদর্শন চলছে। এক পর্যায়ে লাশ ফেলে দেবার মত হুমকী কার্যকর করতে তারা প্রস্তুত। চেয়ারম্যান সাহেবসহ এলাকার গন্যমান্য সবাই বিব্রত এবং শংকিত।
আজ সেই ঐতিহাসিক মহড়ার স্টেজ রিহার্সেল হবে স্কুল মাঠে। ব্যাপারটা উত্তেজনার, কিন্তু দুঃখজনক। রাত পেরুলেই আগামীকাল সেই যুদ্ধ হবে খোলাখুলি। প্রশাসন সরে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ওনারা চিন্তিত। রাতে মোবাইল ফোনে কেউ একজন দুবাড়ীরই দুটো মোবাইলে ম্যাসেজ দিলো- আপনেরা যদি না থামেন তবে আপনেগো বাড়ীর পিছনে একটা করে ডানু’র কৌটা পুঁতে রাখা আছে। কৌটা মানে বোঝেনইতো ফেটে গেলে- ডিসকোবাড়ী, মেমবাড়ীর সব লন্ডভন্ড হবে। মাত্র আড়াইঘন্টা সময়।
তারপর কিসের লড়াই কিসের কি। সবাই যার যার বাড়ীর আশপাশ খোঁজাখুঁজি, খোড়াখুঁড়ি শুরু করে। প্রাণনাশ, জিনিসপত্র ধ্বংসের কথা বিবেচনা করে ঘরের বাইরে সব আনা হচ্ছে টানাহেঁচড়া করে। আড়াই ঘন্টায় যতটুকু পারা যায়। বেঁধে দেয়া সময়টা পার হল। দুবাড়ীরই লোকজন দুটো বড় সাইজের ডানো’র কৌটা পেয়েছে। ভেতরে বোমা টুমার খবর নেই। আছে একটি চিরকুট।
একটি লেখা- আমরা সবাই একই গ্রামে বাস করি। চলুন ঝগড়া না করে সবাই মিলে মিশে গ্রামে থাকি। উড়ো মোবাইল ফোনটা কে করল ঠিক বোঝা গেল না। তবে দুবাড়ীর মধ্যকার পাল্টাপাল্টি ঠেলাঠেলিটা শিথিল হয়ে গেল।
গড়িয়ে গেল দশ বছর। দুবাড়ীর ওই ছেলে মেয়ে দুটো ভালবাসাবাসি করেছে এবং বিয়ে হচ্ছে তাদের মহা ধুমধামে। দুবাড়ীতেই জবাই হবে একশটা করে খাসী। বাসর রাতে ছেলে মেয়ে দুটো এই প্রথম ফাঁস করল তথ্য-দশ বছর আগে মোবাইল ফোনটা ওরাই করেছিল। পাল্টাপাল্টির অভ্যাসটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এবার ওরা জেদ ধরল- উভয়েই পাঁচশত জন ভূখা মানুষকে খাওয়াবে।
ডিসকোবাড়ীরা পদপে নিল গ্রামের রাস্তাটা পাকা করার যাবতীয় খরচ দেবে। মেমবাড়ীদের প থেকে ঘোষণা হলো ওরা গ্রামে একটা হাসপাতাল খুলবে।