জাহেদ আলী মংলা, যাত্রাশিল্পের প্রবাদ প্রতিভা...

--------------দী প ক  স র কা র
প্রাচুর্য, প্রভাবে রাজ্য ষোলকলায় পূর্ণদুঃখ এই, রাজার পুত্র নেইবংশবিলোপ সম্ভাবনায় ভীষণ চিন্তিত রাজাএকদিন পুত্র কাঙ্গাল রাজাকে দরবেশ বললেন, রাজপুত্র হবে আপনার তবে-বারো দিনের রাজপুত্রকে বিয়ে দিতে হবে বারো বছরের কন্যার সাথে এবং রাজপুত্র ও রাজবধূ চলে যেতে হবে বনবাসেতাই হবে তবুও রাজপুত্র চাই রাজার এবং হলোও তাইবারো বছরের উজির কন্যা রূপবান বারো দিনের রাজপুত্র স্বামী রহিমকে নিয়ে চলে গেলো বনবাসেস্ত্রী রূপবান স্বামী রহিমকে কোলে পীঠে করে বহু প্রতিকূলতায় কাটাতে লাগলো বনজীবনশৈশব, কৈশর পেরিয়ে প্রদীপ্ত যৌবনে
এসে খেই হারালো রহিমরহিম এবার মত্ত তাজেলের প্রেমেসতী রূপবানের জীবনে ঝড় উঠলো লাঞ্চনা-বঞ্চনা তথা রহিমকে হারানোর রূপবান লাঞ্চনার কষ্টদৃশ্য সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ কন্ঠে চিকার করে মঞ্চে উঠে গেলো রূপবানযাত্রা পালার এক কিশোর দর্শক, নাম জাহেদ আলী মংলা; পরবর্তিতে যিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুপরিচিত হয়েছেন মংলা ভাই নামেহ্যাঁ ৪২ বছর পূর্বে নেত্রকোণা-দুর্গাপুরের কাকৈরগড়া ইউনিয়নের নিজ গ্রাম গোপালপুরে অনুষ্ঠিত রূপবানযাত্রাপালা বদলে দেয় প্রতিভাবান জাহেদ আলী মংলার জীবন ভাবনাপল্লী সংস্কৃতি, কবিতা চর্চা, গান এবং যাত্রাশিল্পের উকর্ষতার চাদরে জড়িয়ে নেন নিজেকেনিজেই রচনা করেন বিভিন্ন কাহিনীঘেঁষা নাটক, মঞ্চস্থ হয় বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, সুনামগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তেসহস্র সহস্র মানুষের মনে গেঁথে গেলো একটি নাম, জাহেদ আলী মংলাক্রমাগত তিনি হয়ে উঠলেন যাত্রাশিল্পের পুরোধা

মঞ্চ জীবনে জাহেদ আলী মংলার বিভিন্ন মঞ্চ নাটকের মধ্যে- মায়ের কোলে কাঠের পুতুল, সতীর কোলে জারজ সন্তান, অভীশপ্ত জংলী কন্যা, রক্তে রাঙ্গা বাসর, জীবন সাথী, প্রেমের জলন্ত প্রমান, বিনামূল্যে দাসী কাহিনীগুলো অন্যতমএগুলোর মাঝে মায়ের কোলে কাঠের পুতুলএকাধিক বার বিটিভি ও চ্যানেল ওয়ান এ সম্প্রচার হয়েছেঅথচ অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, কাহিনীগুলোর কোন পান্ডুলিপি নেইযেনো তাঁর মেধা-মনন কাহিনীগুলোর ধূসর পান্ডুলিপিস্মৃতিশক্তি তাঁর এতই তিক্ষ্ম যে, বৃদ্ধের বারান্দায় দাঁড়িয়েও অনর্গল বলে যান প্রতিটি কাহিনী পর্বসদাহাস্য মংলার কন্ঠে এখনও অমৃতসুধা, কথায় ছন্দের স্পন্দন; এখনও তাঁর হৃদয়নদীতে ভালোবাসার পূর্ণ জলোচ্ছ্বাসষাটের বৃত্তে পা দেয়া মংলার সাথে কথা বললে মনে হয়, যেনো এখনও তিনি দাঁড়িয়ে আছেন আলো ঝলমল কোন যাত্রামঞ্চেযেনো পল্লীর এক মাঠে জ্বলছে অনেকগুলো হ্যাজাক, মাঝখানে একটি মঞ্চে বসে আছেন কাঞ্চনপুরের রাজা, কাউকে নির্দেশ দিচ্ছেন নির্বাসনের, খোঁজ নিচ্ছেন রাজ্যের-চারদিকে সভাসদ, এরই মাঝে মাটিতে শিকড় গেঁথে দাঁড়িয়ে আছেন স্বপ্নের মতো বড় একজন মানুষ; জাহেদ আলী মংলাপেশাগত উকর্ষ কিংবা নেশা- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সূচনা পর্বটি মঞ্চনেশা হলেও একসময় তা পেশায় পরিনত হয় কিংবা পরিনত হয় জীবনবোধেতিনি আরো বলেন, পেশা বলতে এখনকার মত পুরো বানিজ্যিক নয়; ছিলো প্রকৃত অভিনয় তথা সংস্কৃতি চর্চার কমিটম্যান্ট বা প্রতিশ্রুতিহ্যাঁ জনশ্রুতি আছে যে, জাহেদ আলী মংলা প্রকৃত সংস্কৃতি চর্চার প্রতিশ্রুতি নিয়েই কাজ করতেনকোন জায়গা থেকে আমন্ত্রণ এলেই ছুটতেন দলবল নিয়েঅসংখ্য মানুষকে প্রকৃত মনোরঞ্জন দিয়েই তৃপ্ত হতেন তিনি, সহস্র মানুষের ভালোবাসায় হতেন সিক্তজীবনভর ভালোবাসা কুঁড়িয়েছেন, তাই দেশের অনেক গুণী মানুষের সাথে ছিলো মনন সম্পৃক্ততা, যেমন সম্পৃক্ততা কিংবা সখ্য ছিলো বরেণ্য শিল্পী কদ্দুস বয়াতীর সাথেজাহেদ আলী মংলা নিজেও বরেণ্য, তাই সখ্য এখনও আছে দেশের বহু বরেণ্যদের সাথেশুধু আমরাই নিজেদের মননের দৈন্য কাটিয়ে উঠতে পারিনি, বরণ করতে পারিনি আমাদের মানুষ, আমাদে পড়শি যাত্রাশিল্পের এ দরদি প্রতিভাকেকিন্তু এ নিয়ে মংলার যেনো কোন আকাক্সা কিংবা অভিমান নেই বরং অতিবাহিত সময় একবিন্দুও তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনিযেনো তাঁর ঋদ্ধ মননে কখনও শৈথিল্য প্রবেশের অনুমতি পায়নিতিনি এখনও জীবিত মঞ্চ ভাবনা এবং সৃজনশীলতায়

পল্লী সংস্কৃতির চেতনা বিকশিত, গভীর আবেগস্পর্শী মংলা একদিকে যেমন যাত্রাশিল্পের প্রবাদ প্রতিভা তেমনি, একজন নিভৃতচারী শুদ্ধ কবিতাকর্মীতাঁর কবিতায় নিসর্গ, প্রণয়-বিরহ, মানুষের অন্তর্গত রণ, স্বদেশ ও সমাজ চমকার বুননে বর্তমানরাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন এভাবে, “কৃষ্ণ প্রেমে বাধা রাধার প্রাণ/ও সখিরে সেযে শুনলে বাঁশি হয় উদাসী/ডরায় না কূলমান/... জাহেদ মংলা ভাই কয় কৃষ্ণ রাধা/ দুই জনা এক সুতায় বাধাতাঁর অনেক কবিতা রূপক, চিত্রকল্প, বুননশৈলীতে বিদ্দ্যুচ্চমক সৃষ্টি করে; যদিও কবিতাগুলোর গঠন পুরোপুরি আধুনিক বাংলা কবিতার মতো নয়জাহেদ আলী মংলা কবিতা ছাড়াও দুশোর বেশি গান লিখেছেন, গানগুলোর বেশিরভাগই মারফতি, মুর্শিদীগান, কবিতা, যাত্রা এই ত্রি-গুণ ছাড়াও ব্যক্তি মংলা এক অসাধারণ চরিত্র

জাহেদ আলী মংলা মূলতঃ লোকবাংলার চেতনাকে সর্বত্র ধারন করেনকাজ করেন প্রায় হারিয়ে যাওয়া লোকশব্দ নিয়েতার কবিতাতেও সরল লোকশব্দের ব্যবহার দেখা যায়লোকজীবন বলতে যা বোঝায় মংলা আদ্যোপান্ত সে লোকজীবন ঘেঁষা মানুষতাই তিনি নগরের কর্মযজ্ঞকে স্বীকৃতি দিলেও লোকশব্দ, লোকজীবনকে ম্লান করে দেননি, যে কাজটি প্রায়ই কবি, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিকরা দ্বিধাহীন করে চলেছেনঅন্যরা যেখানে প্রথা ভেঙ্গে, সমাজ ভেঙ্গে রাতারাতি নিজেকে বদলাতে চান, বদলাতে গিয়ে ভুলে যান শিকড়; হয়ে যান অন্যের মত অবিকল কিন্তু মংলা সেখানে ব্যতিক্রমতিনি যা ভাঙ্গতে চান তা হল কুপ্রথা এবং রা করতে চান প্রথাতাই প্রথা রক মংলা সরল স্বপ্নে বিভোরতাই তিনি অনেক অডিটরিয়ামে কাজ করলেও তার স্বপ্ন গাভীনা, পাইকপাড়া কিংবা একটি দশাল গ্রাম; যেখানে একটি মাঠ কিংবা ধানকাটা একটি ক্ষেতে বসানো হয়েছে কটি চৌকি, জ্বলছে হ্যজাক- দূর থেকে ধেয়ে আসছে অগনিত টর্চলাইট, শত সহস্র মানুষ মাটিতে খড় ছিটানো সমান আসনে বসে শুনছে যাত্রাপালা কিংবা কবিতা, লোকগাথাসেখানে কোন বৈষম্য নেই, সবাই এখানে দর্শক-শ্রোতা, সবার শ্রমে এ আয়োজনজাহেদ আলী মংলা এখনও স্বপ্ন দেখেন কেউ একজন আসছেন তার সৃজনের খোঁজ নিতেস্বপ্ন দেখেন, মনন পান্ডুলিপিতে লেখা তাঁর যত যাত্রাকথা, কবিতা, লোককথা সংগ্রহ হচ্ছে, সংরণ হচ্ছে, হচ্ছে প্রকাশআজ দায়বোধের পরীক্ষা আমাদেরআমরা যারা দাবী করি প্রগতির প্রতিনিধি, ঐতিহ্যের ধারক, সুজন কিংবা সুবক্তা; রাজনীতি কিংবা সভ্যতার কারিগর- মংলার স্বপ্নের পরিচর্যার মূল দায়িত্ব আজ তাদেরনতুবা উপরোক্ত কোনটিই আমরা নইআমাদের বোধের বলয় আজ গড়তে পারে যাত্রাশিল্পের প্রবাদ প্রতিভা জাহেদ আলী মংলার স্বপ্নের সেতু বন্ধনপ্রতিক্ষা আজ প্রোপটের- সেতুবন্ধন কিংবা সেতু ভাঙ্গন!
 
Design by নেত্রকোনার আলো | সম্পাদক - সোহেল রেজা | Email-netrakonaralo@gmail.com