-------------সঞ্জয় সরকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালী জীবনে প্রাতঃস্মরণীয়। তাঁর জন্য আমাদের বাঙালী পরিচয় আজ গর্বিত, মহিমান্বিত। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন মানেই সমগ্র বাঙালী জাতির সীমাহীন গৌরব ও অহংকারের একটি দিন। তাই সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবছর বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয় এ দিনটি। কিন্তু রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালনের একটি চমকপ্রদ তথ্য অনেকের কাছেই আজও অজানা। আর তা হলো
শান্তিনিকেতনের বাইরে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশ্যে জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করা হয়েছিল এই বাংলাদেশেই। বিশ্ব কবির ঊনসত্তর বছরপূর্তিতে সে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল তখনকার ছোট্ট মহুকুমা শহর নেত্রকোণায়। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ সংগীতজ্ঞ শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন ওই অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা। ১৯৩০ সালে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানটিই যে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান কবি নিজেই দিয়ে গেছেন এর দালিলিক স্বীকৃতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালী জীবনে প্রাতঃস্মরণীয়। তাঁর জন্য আমাদের বাঙালী পরিচয় আজ গর্বিত, মহিমান্বিত। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন মানেই সমগ্র বাঙালী জাতির সীমাহীন গৌরব ও অহংকারের একটি দিন। তাই সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবছর বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয় এ দিনটি। কিন্তু রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালনের একটি চমকপ্রদ তথ্য অনেকের কাছেই আজও অজানা। আর তা হলো
শান্তিনিকেতনের বাইরে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশ্যে জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করা হয়েছিল এই বাংলাদেশেই। বিশ্ব কবির ঊনসত্তর বছরপূর্তিতে সে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল তখনকার ছোট্ট মহুকুমা শহর নেত্রকোণায়। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ সংগীতজ্ঞ শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন ওই অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা। ১৯৩০ সালে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানটিই যে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান কবি নিজেই দিয়ে গেছেন এর দালিলিক স্বীকৃতি।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা শৈলজা রঞ্জন মজুমদারের জন্ম ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৪ শ্রাবণ), নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহাম গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে। নেত্রকোণা শহরের সাতপাই এলাকাতেও (থানার পশ্চিমে) তাঁদের নিজস্ব বাসা ছিল। বিশিষ্ট আইনজীবী রমণী কিশোর দত্ত মজুমদার ও সরলা সুন্দরী মজুমদারের আট সন্তানের মধ্যে শৈলজা রঞ্জন মজুমদার ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ। ৮-৯ বছর বয়সে পাঠশালায় পড়ার সময় ঠাকুরমার (প্রখ্যাত লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর পিসিমা) কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয় তাঁর। শৈশবে কীর্তন, শ্যামাসংগীত, বাউল, ভাটিয়ালী, ঢপ প্রভৃতি যা শুনতেন তাই গাওয়ার চেষ্টা করতেন তিনি। যদিও তখনকার দিনে মধ্যবিত্ত সমাজে গান-বাজনা কিছুটা নিন্দনীয় বলে গণ্য ছিল। এ কারণে কিছুটা বাধা ছিল তাঁর পরিবার থেকেও। বাড়িতে গান শেখার ক্ষেত্রে আপত্তি না করলেও প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি ছিল পিতার। একবার পাঠশালায় একটি সংস্কৃত শ্লোক সুর করে গাইবার জন্য তাকে মনোনীত করা হলে পিতা ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন গানে মাততে দিলে ফাজিল হয়ে যাবে’। বলাবাহুল্য, তখনকার সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস বা ধারণাই ছিল এ আপত্তির কারণ। পিতা রমণী কিশোর দত্ত মজুমদারের ইচ্ছা ছিল শৈলজারঞ্জন মজুমদার তাঁর আইন ব্যবসার অগাধ প্রসারের উত্তরাধিকারী হবেন। সে লক্ষ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি পাস করার পর আইন বিষয়েও পড়িয়েছিলেন তাঁকে। ওকালতি পাস করার পর আইন ব্যবসায় যোগদানের সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিলেন তাঁর পিতা। কিন্তু আইন ব্যবসায় যোগদানের বিষয়টি মনঃপূত হচ্ছিল না তাঁর। সংগীতের টানে, বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি বিশেষ অনুরাগের কারণে তাঁর মন পড়েছিল কলকাতায়। আর ঠিক সে সময়েই, জীবনের মোড় পরিবর্তনের সুবর্ণ সুযোগটি পেয়ে যান তিনি। ১৯৩২ সালে বিশ্বভারতী থেকে তাঁকে আহ্বান জানানো হয় শান্তিনিকেতনে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিতে। পিতা কিছুটা গররাজি থাকলেও ছেলের অধীর আগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়াননি। তাই শৈলজারঞ্জন মজুমদার অনায়াসে যোগদান করলেন বিশ্বভারতীতে। ক্রমান্বয়ে সেখানেই তাঁর ‘বিজ্ঞানের রসায়ন রাগ রাগিনীর রসায়নে’ পরিণত হয় (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়)।
এখানে উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পরিচয় হয়েছিল আরও কয়েক বছর আগেই। ম্যাট্রিক পাস করার পর ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতায় গিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। তখন আত্মীয়তার সুবাদে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর কলকাতার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। সেখানে সংস্কৃতি চর্চার এক মনোরম পরিবেশ পান তিনি। ওই বাড়িতেই ১৯২০ সালে প্রথম শোনেন রবীন্দ্রনাথের (তখনকার ভাষায় রবিবাবুর) গান। পরের বছর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের নিজ কণ্ঠে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ ও ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ আবৃত্তি শুনে তিনি অভিভূত হন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়েন রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি।
১৯২৯ সালে ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর সহযোগিতায় প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ শীতল মুখোপাধ্যায়ের কাছে এসরাজ শেখার সুযোগ পান শৈলজারঞ্জন মজুমদার। জমিদারের পুত্র বীরেন্দ্র কিশোরও ছিলেন শীতল মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র। এ সময় (১৯২৯) তিনি রবীন্দ্রসংগীত শেখার অদম্য ইচ্ছায় সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর দলের সদস্য হিসেবে জোড়াসাঁকোয় ‘পাগলাঝোরা’ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পান। ওই অনুষ্ঠানের সুবাদে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে তিনটি গান শেখার সৌভাগ্য জোটে তাঁর। এছাড়া কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রত্যেক রবিবারের আসরেও রবীন্দ্রনাথের গান শুনতেন তিনি। এভাবেই পরিপূর্ণ করতে থাকেন নিজের ভা-ারকে। এ প্রসঙ্গে কলকাতা থেকে প্রকাশিত নেত্রকোনা সম্মিলনীর মুখপত্র ‘সুনেত্র’ (বিশেষ দ্বাবিংশ সংখ্যা, ১৯৯২-৯৩) পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে (সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন তুষার রঞ্জন পত্রনবীশ) শৈলজারঞ্জন মজুমদার বলেন ‘শান্তিনিকেতনে যাওয়ার ভূমিকা যেন ভগবান অনেক, অনেক আগে থেকেই ঠিক করে দিচ্ছিলেন এবং আমাকে নানাভাবে তৈরি করছিলেন’।
১৯৩২ সালে বিশ্বভারতীতে যোগদানের পর শৈলজারঞ্জন মজুমদার রবীন্দ্রনাথের গানের ভা-ার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নিয়মিত সংগীত শিখতে শুরু করেন। পরবর্তীতে দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁকে সংগীত শেখাবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শৈশবে পরিবারের কঠোর অনুশাসনের কারণে সংগীত চর্চায় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলেও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় খ্যাতির মধ্য গগনে। ১৯৩৪ সালে তিনি সর্বপ্রথম ‘মম মন উপবনে’ সংগীতটির স্বরলিপি তৈরি করেন এবং তা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ করে কবির বিশেষ প্রশংসা কুড়ান। এরপর কবি তাঁকে গানের স্বরলিপি তৈরির ব্যাপারেও শিক্ষা দিতে শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি কবিগুরুর বিখ্যাত নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ১৯৩৮ সালে ‘চ-ালিকা’র স্বরলিপি প্রকাশ করেন। এভাবে তিনি যখন রবীন্দ্রসংগীতের সারবস্তুকে অনুধাবন করে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে ঠিক তখন ১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করেন। দীর্ঘ বিশ বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৫৯ সালে তিনি ওই পদ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে তিনি ‘সুরঙ্গমা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। কলকাতার নামীদামী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা যুক্ত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। শৈলজারঞ্জন মজুমদার একদিকে যেমন রবীন্দ্রসংগীতের নির্ভুল গায়ক ছিলেন, তেমনি ছিল তাঁর শিক্ষণ পদ্ধতি। এছাড়া রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপিকার হিসেবে তো তার দক্ষতা ছিল সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে কবির শেষ জীবনে রচিত গানগুলোকে তিনি ধরে রেখেছিলেন তাঁর স্বরলিপি দিয়ে। শৈলজা রঞ্জন মজুমদারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যটি ছিল তিনি নিজের গায়কসত্তাকে প্রচ্ছন্ন রেখে মন দিয়েছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের তৈরির কাজে। ভারত-বাংলাদেশের অনেক রবীন্দ্রসংগীত প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল তাঁর সান্নিধ্যে এসে। জীবনে অনেক সম্মান-পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে বিশ্বভারতী প্রদত্ত দেশিকোত্তম, রবীন্দ্রভারতী থেকে সম্মানসূচক ডিলিট্ উপাধি এবং সুরেশ সংগীত সংসদ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ সংগীতকার হিসেবে স্বর্ণপদক অন্যতম। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। ‘সুনেত্র’ পত্রিকায় (দ্বাবিংশ সংখ্যা) প্রকাশিত ‘আমার দাদা সংগীতগুরু শৈলজারঞ্জন মজুমদার’ শীর্ষক এক নিবন্ধে তাঁর ছোট সহোদর ড. দেবজ্যোতি দত্ত মজুমদার লিখেছেন ‘রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনে সামান্যতম কোন ভুলত্রুটি বা অসঙ্গতিকে তিনি ক্ষমার চোখে দেখতেন না। রবীন্দ্রসংগীতের সহযোগী যন্ত্র হিসেবে হারমোনিয়াম ব্যবহারের বিরুদ্ধে তাঁর একক সংগ্রাম তো কারও অজানা নেই। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর কাছে উপাস্য দেবতার মতো, আর ‘গীতবিতান’ ছিল তাঁর কাছে বেদ বা গীতার মতোই পবিত্র গ্রন্থ। ওদিকে রবীন্দ্রনাথও তাঁকে ভালবাসতেন নিবিড় মমতায়। একবার জন্মদিনে তাঁকে (শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে) এভাবেই আশীর্ব্বাণী দিয়েছিলেন কবি :
“জন্মদিন এল তব আজি,ভরি লয়ে সংগীতের সাজি
বিজ্ঞানের রসায়ন রাগ রাগিনীর রসায়নে
পূর্ণ হল তোমার জীবনে।
কর্মের ধারায় তব রসের প্রবাহ যেথা মেশে
সেইখানে ভারতীর আশীর্ব্বাদ অমৃত বরষে।”
এখানে উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পরিচয় হয়েছিল আরও কয়েক বছর আগেই। ম্যাট্রিক পাস করার পর ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতায় গিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। তখন আত্মীয়তার সুবাদে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর কলকাতার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। সেখানে সংস্কৃতি চর্চার এক মনোরম পরিবেশ পান তিনি। ওই বাড়িতেই ১৯২০ সালে প্রথম শোনেন রবীন্দ্রনাথের (তখনকার ভাষায় রবিবাবুর) গান। পরের বছর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের নিজ কণ্ঠে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ ও ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ আবৃত্তি শুনে তিনি অভিভূত হন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়েন রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি।
১৯২৯ সালে ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর সহযোগিতায় প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ শীতল মুখোপাধ্যায়ের কাছে এসরাজ শেখার সুযোগ পান শৈলজারঞ্জন মজুমদার। জমিদারের পুত্র বীরেন্দ্র কিশোরও ছিলেন শীতল মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র। এ সময় (১৯২৯) তিনি রবীন্দ্রসংগীত শেখার অদম্য ইচ্ছায় সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর দলের সদস্য হিসেবে জোড়াসাঁকোয় ‘পাগলাঝোরা’ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পান। ওই অনুষ্ঠানের সুবাদে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে তিনটি গান শেখার সৌভাগ্য জোটে তাঁর। এছাড়া কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রত্যেক রবিবারের আসরেও রবীন্দ্রনাথের গান শুনতেন তিনি। এভাবেই পরিপূর্ণ করতে থাকেন নিজের ভা-ারকে। এ প্রসঙ্গে কলকাতা থেকে প্রকাশিত নেত্রকোনা সম্মিলনীর মুখপত্র ‘সুনেত্র’ (বিশেষ দ্বাবিংশ সংখ্যা, ১৯৯২-৯৩) পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে (সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন তুষার রঞ্জন পত্রনবীশ) শৈলজারঞ্জন মজুমদার বলেন ‘শান্তিনিকেতনে যাওয়ার ভূমিকা যেন ভগবান অনেক, অনেক আগে থেকেই ঠিক করে দিচ্ছিলেন এবং আমাকে নানাভাবে তৈরি করছিলেন’।
১৯৩২ সালে বিশ্বভারতীতে যোগদানের পর শৈলজারঞ্জন মজুমদার রবীন্দ্রনাথের গানের ভা-ার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নিয়মিত সংগীত শিখতে শুরু করেন। পরবর্তীতে দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁকে সংগীত শেখাবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শৈশবে পরিবারের কঠোর অনুশাসনের কারণে সংগীত চর্চায় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলেও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় খ্যাতির মধ্য গগনে। ১৯৩৪ সালে তিনি সর্বপ্রথম ‘মম মন উপবনে’ সংগীতটির স্বরলিপি তৈরি করেন এবং তা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ করে কবির বিশেষ প্রশংসা কুড়ান। এরপর কবি তাঁকে গানের স্বরলিপি তৈরির ব্যাপারেও শিক্ষা দিতে শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি কবিগুরুর বিখ্যাত নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ১৯৩৮ সালে ‘চ-ালিকা’র স্বরলিপি প্রকাশ করেন। এভাবে তিনি যখন রবীন্দ্রসংগীতের সারবস্তুকে অনুধাবন করে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে ঠিক তখন ১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করেন। দীর্ঘ বিশ বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৫৯ সালে তিনি ওই পদ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে তিনি ‘সুরঙ্গমা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। কলকাতার নামীদামী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা যুক্ত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। শৈলজারঞ্জন মজুমদার একদিকে যেমন রবীন্দ্রসংগীতের নির্ভুল গায়ক ছিলেন, তেমনি ছিল তাঁর শিক্ষণ পদ্ধতি। এছাড়া রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপিকার হিসেবে তো তার দক্ষতা ছিল সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে কবির শেষ জীবনে রচিত গানগুলোকে তিনি ধরে রেখেছিলেন তাঁর স্বরলিপি দিয়ে। শৈলজা রঞ্জন মজুমদারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যটি ছিল তিনি নিজের গায়কসত্তাকে প্রচ্ছন্ন রেখে মন দিয়েছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের তৈরির কাজে। ভারত-বাংলাদেশের অনেক রবীন্দ্রসংগীত প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল তাঁর সান্নিধ্যে এসে। জীবনে অনেক সম্মান-পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে বিশ্বভারতী প্রদত্ত দেশিকোত্তম, রবীন্দ্রভারতী থেকে সম্মানসূচক ডিলিট্ উপাধি এবং সুরেশ সংগীত সংসদ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ সংগীতকার হিসেবে স্বর্ণপদক অন্যতম। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। ‘সুনেত্র’ পত্রিকায় (দ্বাবিংশ সংখ্যা) প্রকাশিত ‘আমার দাদা সংগীতগুরু শৈলজারঞ্জন মজুমদার’ শীর্ষক এক নিবন্ধে তাঁর ছোট সহোদর ড. দেবজ্যোতি দত্ত মজুমদার লিখেছেন ‘রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনে সামান্যতম কোন ভুলত্রুটি বা অসঙ্গতিকে তিনি ক্ষমার চোখে দেখতেন না। রবীন্দ্রসংগীতের সহযোগী যন্ত্র হিসেবে হারমোনিয়াম ব্যবহারের বিরুদ্ধে তাঁর একক সংগ্রাম তো কারও অজানা নেই। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর কাছে উপাস্য দেবতার মতো, আর ‘গীতবিতান’ ছিল তাঁর কাছে বেদ বা গীতার মতোই পবিত্র গ্রন্থ। ওদিকে রবীন্দ্রনাথও তাঁকে ভালবাসতেন নিবিড় মমতায়। একবার জন্মদিনে তাঁকে (শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে) এভাবেই আশীর্ব্বাণী দিয়েছিলেন কবি :
“জন্মদিন এল তব আজি,ভরি লয়ে সংগীতের সাজি
বিজ্ঞানের রসায়ন রাগ রাগিনীর রসায়নে
পূর্ণ হল তোমার জীবনে।
কর্মের ধারায় তব রসের প্রবাহ যেথা মেশে
সেইখানে ভারতীর আশীর্ব্বাদ অমৃত বরষে।”
১৯২১ সাল থেকে গ্রীষ্মের ছুটিতে কলকাতা থেকে নেত্রকোনায় এসে স্থানীয় শিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীতসহ অন্যান্য গান, কবিতা আবৃত্তি শেখাতেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩০ সালে তিনি নেত্রকোনায় উদ্যাপন করেন রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রথম অনুষ্ঠানটি। এ প্রসঙ্গে শৈলজারঞ্জন মজুমদার নিজেই বলেছেন ‘সমগ্র বাংলাদেশে এর আগে রবীন্দ্রজয়ন্তীর কোনো অনুষ্ঠান হয়নি।’ বলাবাহুল্য, তখনকার মধ্যবিত্ত বাঙালী হিন্দু সমাজে রবীন্দ্রনাথের প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব সক্রিয় ছিল। এছাড়া মেয়েরা বাড়িতে গান শিখলেও সাধারণত বাড়ির বাইরে গান পরিবেশন করতে যেতেন না। কেবল শৈলজারঞ্জন মজুমদারের একক প্রচেষ্টার কারণেই সম্ভব হয়েছিল সে অসাধ্য কাজটি। ওই সময় নেত্রকোনায় সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন করার মতো কোনো অডিটরিয়াম, প্রেক্ষাগৃহ বা মঞ্চ ছিল না। ছিল না বিদ্যুৎ বা আধুনিক ডেকোরেশন ব্যবস্থাও। জেলা শহরের সুপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্বপাশের লম্বা ঘরটির দক্ষিণ পাশে তক্তপোষ (চৌকি) জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয় মঞ্চ। মঞ্চের পেছনে সাদা পর্দা দিয়ে সজ্জিত বেদিতে রাখা হয় কবির প্রতিকৃতি। মঞ্চের চারপাশ সাজানো হয় দেবদারু পাতা আর কৃষ্ণচূড়াসহ বিভিন্ন ফুল দিয়ে। কয়েকটি হ্যাজাক লাইট দিয়ে করা হয় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা।
সত্যকিরণ আদিত্য সম্পাদিত ‘সুনেত্র’ পত্রিকার ত্রয়োবিংশ সংখ্যায় (১৯৯৪-৯৫) সলিল চন্দ্র বর্ধন ‘নেত্রকোণায় রবীন্দ্রজয়ন্তী ও শৈলজারঞ্জনের ভূমিকা’ শীর্ষক নিবন্ধে নেত্রকোনায় প্রথম বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের কিছুটা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এতে জানা যায় কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে ২৫শে বৈশাখ অনুষ্ঠানটি করা যায়নি। তা মঞ্চস্থ করা হয়েছিল দু’দিন পর। অনুষ্ঠানের শুরুতে সম্মিলিত কণ্ঠে পরিবেশন করা হয় বৈদিক গান। এরপর কবিকৃত শ্লোকের বাংলা রূপান্তর ‘যদি ঝড়ের মেঘের মত আমি ধাই চঞ্চল অন্তর’ পরিবেশনের পর মেয়েরা শঙ্খধ্বনিসহ দীপ, ধূপ, ফুল, চন্দন ও মালা দিয়ে বরণ করে কবির প্রতিকৃতিকে। বরণ পর্ব শেষ হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে পরিবেশন করা হয় সম্মেলক, একক ও যুগ্মগান। মাঝে মাঝে আবৃত্তি করা হয় দু’-একটা কবিতাও। অনুষ্ঠানের পর দর্শক-শ্রোতারা অভিভূত হয়ে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন শৈলজারঞ্জনকে। ১৯৩০ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত শৈলজারঞ্জন মজুমদারের তত্ত্বাবধানে নেত্রকোনায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের ধারাবাহিকতাটি বজায় ছিল। অনুষ্ঠানের আগে তিনি নিজেই শিল্পীদের রিহার্সেল করাতেন। নিজেই শেখাতেন নাচের মুদ্রা, অঙ্গভঙ্গি ও লয়-তাল। অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনার জন্য তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করতেন। একবার শহরের নাগড়া গ্রামের এক ভিক্ষাজীবী বৈষ্ণব যুবাকে বাউল বেশে একতারা হাতে গাইয়েছিলেন ‘আমি কান পেতে রই’ গানটি। একই ভাবে উকিলপাড়ার সুনীল সেন বাউল সেজে গেয়েছিলেন ‘এ বেলা ডাক পড়েছে’ গানটি। এসব অনুষ্ঠানে তিনি এবং তাঁর মামা সুরেশ মজুমদার এসরাজ, নিখিল বর্ধন হারমোনিয়াম, সুধীর ঘোষ বেহালা এবং আর দু’-একজন তবলা ও মৃদঙ্গ বাজাতেন। প্রথম বছর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক বীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (তিনি পরবর্তীতে হরিয়ানার রাজ্যপাল হয়েছিলেন) অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী পালন ও রবীন্দ্রচর্চায় ওই সময় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে আরও যারা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন : সুধীর চন্দ্র সেন, জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিমল চৌধুরী, সলিল বর্ধন, ডা. শশী ধর, সৌরীন হোম রায়, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, যতীন্দ্র ঘোষ, সুনীল সেন, হীরেন চক্রবর্তী (আভা), বিমলাংশু চৌধুরী (বাদল), মৃণালিনী চক্রবর্তী (নুইয়া), কচুমনি, সিন্ধুবালা রায়, রানু চৌধুরী, মুকুল বর্ধন, প্রমীলা চৌধুরী, শৈলবালা দেবী, মহকুমা শাসক আর.কে মিত্র, মুনসেফ অচিন্ত্য কুমার সেন, করুণা কেতন সেন, তাঁর স্ত্রী সুধা সেন, চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের রেক্টর সুখরঞ্জন রায়, দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের রেক্টর জ্ঞানেশ চন্দ্র রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পরবর্তী সময়ে (১৯৪১ এরপর) তাঁর অনুসারীরা, স্থানীয় রিক্রিয়েশন ক্লাব, সত্যকিরণ আদিত্য, ডা. অমিয় চক্রবর্তী, কুমুদ রঞ্জন বিশ্বাস, দুর্গেশ চন্দ্র পত্রনবীশ, মিহির মজুমদার ও অতীন হোম রায় প্রমুখ রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন
সত্যকিরণ আদিত্য সম্পাদিত ‘সুনেত্র’ পত্রিকার ত্রয়োবিংশ সংখ্যায় (১৯৯৪-৯৫) সলিল চন্দ্র বর্ধন ‘নেত্রকোণায় রবীন্দ্রজয়ন্তী ও শৈলজারঞ্জনের ভূমিকা’ শীর্ষক নিবন্ধে নেত্রকোনায় প্রথম বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের কিছুটা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এতে জানা যায় কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে ২৫শে বৈশাখ অনুষ্ঠানটি করা যায়নি। তা মঞ্চস্থ করা হয়েছিল দু’দিন পর। অনুষ্ঠানের শুরুতে সম্মিলিত কণ্ঠে পরিবেশন করা হয় বৈদিক গান। এরপর কবিকৃত শ্লোকের বাংলা রূপান্তর ‘যদি ঝড়ের মেঘের মত আমি ধাই চঞ্চল অন্তর’ পরিবেশনের পর মেয়েরা শঙ্খধ্বনিসহ দীপ, ধূপ, ফুল, চন্দন ও মালা দিয়ে বরণ করে কবির প্রতিকৃতিকে। বরণ পর্ব শেষ হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে পরিবেশন করা হয় সম্মেলক, একক ও যুগ্মগান। মাঝে মাঝে আবৃত্তি করা হয় দু’-একটা কবিতাও। অনুষ্ঠানের পর দর্শক-শ্রোতারা অভিভূত হয়ে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন শৈলজারঞ্জনকে। ১৯৩০ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত শৈলজারঞ্জন মজুমদারের তত্ত্বাবধানে নেত্রকোনায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের ধারাবাহিকতাটি বজায় ছিল। অনুষ্ঠানের আগে তিনি নিজেই শিল্পীদের রিহার্সেল করাতেন। নিজেই শেখাতেন নাচের মুদ্রা, অঙ্গভঙ্গি ও লয়-তাল। অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনার জন্য তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করতেন। একবার শহরের নাগড়া গ্রামের এক ভিক্ষাজীবী বৈষ্ণব যুবাকে বাউল বেশে একতারা হাতে গাইয়েছিলেন ‘আমি কান পেতে রই’ গানটি। একই ভাবে উকিলপাড়ার সুনীল সেন বাউল সেজে গেয়েছিলেন ‘এ বেলা ডাক পড়েছে’ গানটি। এসব অনুষ্ঠানে তিনি এবং তাঁর মামা সুরেশ মজুমদার এসরাজ, নিখিল বর্ধন হারমোনিয়াম, সুধীর ঘোষ বেহালা এবং আর দু’-একজন তবলা ও মৃদঙ্গ বাজাতেন। প্রথম বছর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক বীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (তিনি পরবর্তীতে হরিয়ানার রাজ্যপাল হয়েছিলেন) অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী পালন ও রবীন্দ্রচর্চায় ওই সময় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে আরও যারা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন : সুধীর চন্দ্র সেন, জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিমল চৌধুরী, সলিল বর্ধন, ডা. শশী ধর, সৌরীন হোম রায়, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, যতীন্দ্র ঘোষ, সুনীল সেন, হীরেন চক্রবর্তী (আভা), বিমলাংশু চৌধুরী (বাদল), মৃণালিনী চক্রবর্তী (নুইয়া), কচুমনি, সিন্ধুবালা রায়, রানু চৌধুরী, মুকুল বর্ধন, প্রমীলা চৌধুরী, শৈলবালা দেবী, মহকুমা শাসক আর.কে মিত্র, মুনসেফ অচিন্ত্য কুমার সেন, করুণা কেতন সেন, তাঁর স্ত্রী সুধা সেন, চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের রেক্টর সুখরঞ্জন রায়, দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের রেক্টর জ্ঞানেশ চন্দ্র রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পরবর্তী সময়ে (১৯৪১ এরপর) তাঁর অনুসারীরা, স্থানীয় রিক্রিয়েশন ক্লাব, সত্যকিরণ আদিত্য, ডা. অমিয় চক্রবর্তী, কুমুদ রঞ্জন বিশ্বাস, দুর্গেশ চন্দ্র পত্রনবীশ, মিহির মজুমদার ও অতীন হোম রায় প্রমুখ রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন
(সূত্র : নেত্রকোনায় রবীন্দ্রজয়ন্তী একটি ইতিহাস, সত্যকিরণ আদিত্য)।
ড. দেবজ্যোতি মজুমদার লিখেছেন “তখন নেত্রকোনাবাসীর এমন সব রবীন্দ্রসংগীত শুনবার সুযোগ হয়েছিল যা হয়তো তখন শান্তিনিকেতনের বাইরে আর কারো শোনবার সুযোগ হয়নি।…তাছাড়া ‘শ্যামা’, ‘চ-ালিকা’ নৃত্যনাট্য যা রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন মাত্র আগে রচনা করেছেন তা-ও শুনবার ও দেখবার সুযোগ নেত্রকোনাবাসীর হয়েছিল। একই প্রসঙ্গে তুষাররঞ্জন পত্রনবীশ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখায় উল্লেখ করেন “চিত্রাঙ্গদা ও ‘চ-ালিকা’ নৃত্যনাট্যের রূপদানে শৈলজারঞ্জনের অগ্রণী ভূমিকা ছিল যেমন ছিল চিত্রনাট্য ‘শ্যামা’র সম্পাদনায়। শুধু তাই নয়, শান্তিনিকেতনের বাইরে নেত্রকোনাতেই প্রথম এই তিনটি নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়।” কাজেই এ কৃতিত্বের জন্যও শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে নিয়ে নেত্রকোনা অহংকারের দাবি রাখে। তেমনি নেত্রকোণাবাসীর আরেকটি অহংকারের নিদর্শন হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি। নেত্রকোণায় তাঁর জন্মদিন উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতের শৈলাবাস থেকে তিনি শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে লিখেন :
কল্যাণীয়েষু,তোমাদের নেত্রকোনায় আমার জন্মদিনের উৎসব যেমন পরিপূর্ণ মাত্রায় সম্পন্ন হয়েছে এমন আর কোথাও হয়নি। পুরীতে একবার আমাকে প্রত্যক্ষ সভায় নিয়ে সম্মান করা হয়েছিল। কিন্তু নেত্রকোনায় আমার সৃষ্টির মধ্যে অপ্রত্যক্ষ আমাকে রূপ দিয়ে আমার স্মৃতির যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কবির পক্ষে সেই অভিনন্দন আরো অনেক বেশি সত্য। তুমি না থাকলে এই উপকরণ সংগ্রহ করত কে? এই উপলক্ষে বৎসরে বৎসরে তুমি আমার গানের অর্ঘ্য পৌঁছিয়ে দিচ্ছ তোমাদের পল্লীমন্দিরের ভোগম-পেÑ এও কম কাজ হচ্ছে না।
আমর জন্মদিন প্রতিবৎসর তোমাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে উৎসব আমাকে এনে দিচ্ছে ক্লান্তির ডালিতে নতুন বোঝা। এবার পাহাড়ে এখনো দেহমনে অবসাদ আসক্ত হয়ে আছে। পৃথিবী জুড়ে যে শনির সম্মার্জনী চলেছে বোধ হচ্ছে তার আঘাত এসে পড়বে আমার ভাগ্যে।
দেখা হলে নৃত্যকলা সম্বন্ধে মোকাবিলায় তোমার সঙ্গে আলাপ করব।
ইতি ২৫। ৫। ৩৯
তোমাদের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমর জন্মদিন প্রতিবৎসর তোমাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে উৎসব আমাকে এনে দিচ্ছে ক্লান্তির ডালিতে নতুন বোঝা। এবার পাহাড়ে এখনো দেহমনে অবসাদ আসক্ত হয়ে আছে। পৃথিবী জুড়ে যে শনির সম্মার্জনী চলেছে বোধ হচ্ছে তার আঘাত এসে পড়বে আমার ভাগ্যে।
দেখা হলে নৃত্যকলা সম্বন্ধে মোকাবিলায় তোমার সঙ্গে আলাপ করব।
ইতি ২৫। ৫। ৩৯
তোমাদের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রসঙ্গত, আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে মফস্বলের মেয়েদের মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান-নাচ-নৃত্যনাট্য পরিবেশনের কথা ভাবাই যেত না। সমাজের নিন্দা-বিরোধ-সমালোচনা উপেক্ষা করেই রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন নেত্রকোনার মেয়েরা। তথাকথিত সে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে শৈলজারঞ্জনের এই সংগ্রামটিও কী কম কথা? অবশ্য এজন্য সমালোচকদের কঠোর সমালোচনা এবং শাসানিও সহ্য করতে হয়েছে তাঁদের। একবার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে প্রমীলা চৌধুরী ‘কাঁদালে তুমি মোরে ভালবাসারই ঘায়ে’ গানটি পরিবেশন করার পর শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে ব্যাপক তিরস্কার করা হয়। নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘প্রান্তবাসী’ নামে এক পত্রিকায় শৈলজারঞ্জনকে কটাক্ষ করে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় ‘একটি অবিবাহিতা মেয়ের মুখে এমন একটি অশ্লীল গান দিয়া কি তিনি ভাল করিয়াছেন?।’ শুধু হিন্দু মেয়েদের অংশগ্রহণ করিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি শৈলজারঞ্জন। দু’-একজন মুসলিম মেয়েকেও অংশগ্রহণ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এঁদেরই একজন ফিরোজা বেগম। শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ফিরোজা বেগমকে গোঁড়া মুসলমান সমাজ তখন ‘একঘরে’ পর্যন্ত করতে চেয়েছিল। এসব শোনার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে বলেছিলেন ‘এ তুমি করেছ কি? তোমার যে গলা কাটেনি!’বলাবাহুল্য, নেত্রকোনার মাটিতে কখনও পা পড়েনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। একবার তিনি নেত্রকোণার খুব কাছাকাছি ময়মনসিংহ সদর এবং তারও কাছে আঠারবাড়ি পর্যন্ত এসেছিলেন। কিন্তু না এলেও তাঁর অনুভবের জায়গায় স্থান করে নিয়েছিল নেত্রকোনা। নেত্রকোণার প্রতি তাঁর এই ভালাবাসার নেপথ্যে ছিল শৈলজারঞ্জন মজুমদারেরই একক অবদান। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর একটি জানালার নামকরণ করেছিলেন ‘নেত্রকোণা’। এর প্রমাণ আমরা পাই তার শ্যামলী কাব্যের ভূমিকায় :
“…জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে
আমের শাখায় আঁখি ধেয়ে যায় সোনার রসের আশে
লিচু ভরে যায় ফলে,বাদুরের সাথে দিনে আর রাতে অতিথির ভাগ চলে।
বেড়ার ওপারে মৈসুমি ফুলে রঙের স্বপ্ন বোনা,চেয়ে দেখে দেখে জানালার নাম রেখেছি নেত্রকোনা।”
“…জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে
আমের শাখায় আঁখি ধেয়ে যায় সোনার রসের আশে
লিচু ভরে যায় ফলে,বাদুরের সাথে দিনে আর রাতে অতিথির ভাগ চলে।
বেড়ার ওপারে মৈসুমি ফুলে রঙের স্বপ্ন বোনা,চেয়ে দেখে দেখে জানালার নাম রেখেছি নেত্রকোনা।”
সংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কারণেই রবীন্দ্রনাথের প্রীতিধন্য হয়েছিল নেত্রকোণা। কাজেই রবীন্দ্রনাথের জন্যে আমাদের বাঙালী পরিচয় আজ যেমন ধন্য, তেমনি শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে জন্ম দিয়েও ধন্য নেত্রকোণার মাটি। রবীন্দ্রনাথ-শৈলজারঞ্জনের অমূল্য স্মৃতিকে বয়ে চলার এই সুযোগ নেত্রকোণাবাসীর জন্য সত্যিই অশেষ গর্বের, অহংকারের, আনন্দের।