মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ : চারবার ‘এফ’ গ্রেডের পর বৃদ্ধা দাদী বললেন- ওলি ললিরে কলবাদুরের ছাও। পাইল্যা লইল্যা ডাংগর করলাম ফঁড়িং ধইরা খাও..........
স্ত্রী পারুল বিয়ের পর থেকে ‘এফ’ গ্রেড নিয়ে সুযোগ পেলেই খোঁচা দিতো জুলহাস কে। দাদীর যন্ত্রনায় পারুল কে বিয়ে করা। মেট্রিক পাশ, পরীর মত সুন্দর, এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের। এতিম জুলহাসের চাচারা কক্ষচ্যুত গ্রহ। স্ব-স্ব জগতে ব্যস্ত।
বাইক চালিয়ে ভালই আসে। সভা, বিয়ে, খেলা, মেলা, বেড়ানো-লেগেই আছে।
‘অনটেস্ট’ নেইমপ্লেট লাগিয়ে তিন বছর চলে গেল। মফস্বলে কেবল দুএকজনকে কিছু ধরিয়ে দিলেই হয়। এ নিয়ে পারুল বহুবার তর্ক করেছে। বেআইনী কিছু ওর ভাল লাগেনা।
‘অনটেস্ট’ নেইমপ্লেট লাগিয়ে তিন বছর চলে গেল। মফস্বলে কেবল দুএকজনকে কিছু ধরিয়ে দিলেই হয়। এ নিয়ে পারুল বহুবার তর্ক করেছে। বেআইনী কিছু ওর ভাল লাগেনা।
দাদী পুরনো দিনের গল্প বলেন- তোমাগো দাদায় ঘোড়ায় চইড়া যাতায়ত করতো। একদিন একটা সালিশ শ্যাষ কইরা বাড়ী ফিরার পথে ঘোড়া উল্টাইয়া পড়লো তো পড়লোই, আর বাঁচলনা! ....সবাই কয় পিশাচে মাইরা ফালাইছে।.........হের নাতি এহন মেশিনের
ঘোড়া চালায়। কবে পইড়া মরে ঠিক নাই। ডর লাগে। দুনিয়াডা বড় জটিল, তারচে’বেশী জটিল মানুষ, মানুষের মন।
আজ শুক্রবার বিশেষ ছুটির দিন, কিন্তু ওইদিনই জুলহাস বেশী ব্যস্ত থাকে। আয়ও বেশী।
তবে সকালেই উঠেই আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে- সে বাইক নিয়ে বেরুবে না। হেল্থ ভিজিটর সালমা ডেট দিয়েছে আজ পারুলের পেইন উঠতে পারে।
সুতরাং সকাল থেকে জুলহাস উদ্বিগ্ন এবং ঘরে বসা।
সন্ধ্যায় একজন লোক এসে হাউমাউ করে পায়ে পড়ো পড়ো-
লোকটা জানালো, একজন মহিলাকে বাইকে চড়িয়ে রেলস্টেশনে এগারটার ট্রেন ধরাতে হবে। ওর মা ঢাকা পিজিতে ভর্তি। মরণাপন্ন।
জুলহাস ‘না’ বলে দিলো। দাদীও চাচ্ছিলেন, ঘরে নিজেদেরই সমস্যা। কেবল পারুলই তাগাদা দিচ্ছে- সারা জীবনতো টাকাই কামাই করলা। আইজ একটু মানুষের কাজ কর।
কিন্তু তোর যে অবস্থা ......।
আমার সমস্যা হবে না।
জুলহাস মহিলাটাকে চড়িয়ে দ্রুত বেড়িয়ে গেল। রাত এগারটা ট্রেন এলো দেড়ঘন্টা পর। তখন পর্যন্ত স্টেশনে। ট্রেন ছাড়ার পর বাড়ীর পথ ধরল জুলহাস- মোবাইলে ট্রাই করেছে। ওপাশ থেকে বন্ধ। অজানা আশংকা নিয়ে ফিরছে সে।
মাইল দুয়েক আগেই বাইকটা বিগড়ে গেল। অনেক বার ট্রাই করে। শেষে ওটার আশা ছেড়ে মাছ বোঝাই ট্রাকে উঠে ভোর রাতে বাড়ী পৌঁছুলো। ওকে দেখে পারুলের ভায়েরা একটু রেগেই উঠলেন- তোমার আন্দাজটা কেমন কওতো দেহি, মেয়েডার এমন বিপদ, আর তুমি...........?
দাদীর কোলে কেঁদে ওঠা শিশু বাচ্চার কান্না শুনে জুলহাসের ভেতরে নেচে উঠল আহলাদে। পকেট থেকে দুইহাজার টাকা বের করে ওটার হাতে দিয়ে বলল এই নেও, আইজ আমার জীবনের সবচে’ বেশী কামাই তোমারে দিলাম।
দাদী বললেন- তোর শরীরে মাছের গন্ধ, যা গোসল কইয়া আয়, পরে মাইয়ারে কোলে নিবি।
প্রচুর পানি, সাবান খরচ করে গোসল করতে করতে জুলহাস সব ঘটনা বলছে। গোসল শেষে পারুলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ডাকল-পারুল।
আবার ডাকল, একবার, দু’বার। বেশ ক’বার।
পারুলের শ্বাস পড়ছেনা। শক্ত আর ঠান্ডা মেরে আছে গা-টা। জুলহাসের চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এসেছে।
ভিজিটর সালমা এলো।
পারুল নেই। বিছানায় প্রচুর রক্ত। সালমা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। এরকম ঘটনার সামনে আর কোনদিন পড়েনি হয়ত।
জুলহাস ভাবছিলো, পারুলের সাথে সারারাত গল্প বলবে। কিভাবে ভীতু মহিলাটাকে নিয়ে স্টেশনে গেল, খুব জাপটে ধরে ছিল জুলহাসকে। ট্রেন লেইট, মহিলাটা অনেক কিছু খাওয়ালো, ট্রেনে উঠেও জুলহাসের হাতটা কিছুক্ষণ ধরে রেখেছিল.......
পারুলের হয়ত হিংসে হতো শুনে। দাদী বাচ্চাটাকে জুলহাসের কোলে দিয়ে বললেন- কি আর করবি, সবই কপাল। একটু বহ্। আমি বরই পাতা, সাবান, পানির ব্যবস্থা করি।
দিন গড়িয়ে গেল সাতটা। একটা ফোন এলো। পারুল আর তার বাচ্চার কথা জানতে চাইছে একজন মহিলা। ফোনটা কেটে দিলো জুলহাস। আবার ফোন বাজলো। আবার কেটে দিলো। এবার একদম বন্ধ।
বাইকটা আনতে গেল জুলহাস। ওই বাড়ীর একজন ইয়াং ছেলে প্রস্তাব দিলো- ওটা বিক্রি করে দিতে, দিলে সে কিনবে।
জুলহাস প্রথম প্রথম ‘হ্যাঁ’ বলেও পরে আবার ‘না’ বললো।
ওটা এনে ঠিকঠাক করে আবার ছুটে। এখনো ছুটছে।
লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছে। দাদী চলে গেছেন ইতিমধ্যে পরপারে। মেয়েটাকে জুলহাস বিয়ে দিচ্ছে। ও ডাক্তার হয়েছে। হাজবেন্ড বিদেশে থাকে। ওদের সুন্দর গাড়ী গুলোর পাশে ‘এফ’ গ্রেডের জুলহাসের ‘বাইক’ টা নিষ্প্রভ মনে হয়। পাকা চুলে উৎফুল্ল কাশবন।
লিখেছেন : মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
মোবাইল : ০১৭১১৪৬৪৩৪৬