অধ্যাপক আনোয়ার হাসান : আভিধানিক অর্থে দমন শব্দটি বলতে বোঝায় দন্ড দেয়া, শাস্তি দান, শাসন, সংযম, নিবারন ইত্যাদি । তেমনি অবদমন মনের স্বাভাবিক প্রভৃতি বা বাসনা দমন। কাজেই দমন অবদমন শব্দবন্ধটি আমাদের চেতনায় একটি অপ্রীতিকর ভাব চেতনা জাগিয়ে তোলে। মানুষের তৈরি এই আভিধার রয়েছে ইতিহাস পরম্পরা। সময়ের পরিবর্তনের সাথে মানুষের ভৈদ বুদ্ধি ও জীবন মান জটিল হতে শুরু করে। সেই সাথে মানুষের অসহায়ত্ব ও বাড়ে। মানুষ যখন
প্রকৃতির রাজ্যে ছিল তখনও অসহায় অসহায় ছিল। তখন অসহায়ত্ব ছির বিশাল প্রকৃতির কাছে। কিন্তু মানুষে মানুষে ছিল স্বাধীনতা এবং সাম্যের সর্ম্পক। মানুষ সম্মিলিত ভাবে প্রকৃতির নানা প্রতিকুলতার মোকাবেলা করেছে, সংগ্রাম করেছে। তখনও লড়াই সংগ্রাম করেই খাদ্য আহরণ করতে হয়েছে মানুষকে। তবে সেই আহরিত খাদ্য সমান অধিকারের ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে।
প্রকৃতির রাজ্যে ছিল তখনও অসহায় অসহায় ছিল। তখন অসহায়ত্ব ছির বিশাল প্রকৃতির কাছে। কিন্তু মানুষে মানুষে ছিল স্বাধীনতা এবং সাম্যের সর্ম্পক। মানুষ সম্মিলিত ভাবে প্রকৃতির নানা প্রতিকুলতার মোকাবেলা করেছে, সংগ্রাম করেছে। তখনও লড়াই সংগ্রাম করেই খাদ্য আহরণ করতে হয়েছে মানুষকে। তবে সেই আহরিত খাদ্য সমান অধিকারের ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে।
আজকে আমরা যাকে 'ভাগ্য' বলি তাও তো সেই 'ভাগ' শব্দটি থেকেই উদগত। যা শ্রমের সাথে সম্পর্কিত ছিল। অথচ সেই ভাগ্যের চেতনা এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। ঐ সমাজ ছিল মূলত সাম্যবাদী সমাজ। খাদ্যবস্তু সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে আহরিত হতো। শিকারে সকলকে অংশগ্রহণ করতে হতো। অর্থাৎ শ্রমের প্রশ্নের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ ছিল অনিবার্য। অবশ্য তখন খাদ্য আহরণের কৌশল এমন আদিম অবস্থায় ছিল যে, বহু ব্যক্তির সমন্বয় ব্যতীত গোটা শিকার কার্যক্রম সফল করা সম্ভব ছিল না। আর এক ব্যক্তির পে যেখানে একজনের খাদ্য সংগ্রহই ছিল কঠিন, সেখানে উদ্বৃত্ত থাকা তো কল্পনা মাত্র। কিন্তু ক্রমে হাতিয়ারের উন্নতির সাথে সাথে ব্যক্তির স্থান দখল করে নিল হাতিয়ার। ফলে সৃষ্টির হল, আর এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি সৃষ্টির সাথে সাথে মানুষ আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে বেরিয়ে এল। উৎপাদন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে মানুষের সমাজে সৃষ্টি হল স্তরবিভক্তি। এভাবে মানুষের মাঝে শ্রেণী তৈরি হল। তৈরী হল শ্রেণীশোষণ। আর শোষণ এবং শাসনের প্রয়োজনে সমাজ ধীরে ধীরে নানা সংস্কার এবং প্রথার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেল। শুরু হল মানুষ কর্তৃক মানুষের
ওপর দমন-অবদমন। সমাজ সংগঠনের প্রথম ধাপ পরিবার এরপর সমাজ। পরিবার এবং সমাজ চলে সংস্কার এবং প্রথার মাধ্যমে। নানা কুসংস্কার এবং প্রথা পরিবারকে যেমন গ্রাস করে আছে তেমনি সমাজকেও। পরিবারে পুরুষপ্রাধান্য একটি বদ্ধমূল সংস্কার। এই সংস্কার অনুযায়ী নারী অধঃস্তন। কাজেই পুরুষ কর্তৃক নারী নানাভাবে দমনের শিকার হয়। গ্রামীণ পরিবারে এর মাত্রা ভয়ানক। তারা স্বামীর নাম মুখে আনে না। এমনকি ভাসুরের নামও না। আমি এক পরিবারের কথা জানি, ঐ পরিবারে কোন নারী 'সাবান' কথাটি মুখে আনে না। তারা সাবানকে ফেনা বলে। কারণ ঐ পরিবারের বড় কর্তার নাম ছিল সাবান আলী। লোকটি অনেক আগেই মারা গেছে, কিন্তু বংশ-পরস্পরায় সাবান তাদের কাছে ফেনা হিসাবেই পরিচিত। পুরুষ কর্তৃক নারীকে দমনের এর চেয়ে জঘন্য উদাহরণ সম্ভবত আর হতে পারে না।
ওপর দমন-অবদমন। সমাজ সংগঠনের প্রথম ধাপ পরিবার এরপর সমাজ। পরিবার এবং সমাজ চলে সংস্কার এবং প্রথার মাধ্যমে। নানা কুসংস্কার এবং প্রথা পরিবারকে যেমন গ্রাস করে আছে তেমনি সমাজকেও। পরিবারে পুরুষপ্রাধান্য একটি বদ্ধমূল সংস্কার। এই সংস্কার অনুযায়ী নারী অধঃস্তন। কাজেই পুরুষ কর্তৃক নারী নানাভাবে দমনের শিকার হয়। গ্রামীণ পরিবারে এর মাত্রা ভয়ানক। তারা স্বামীর নাম মুখে আনে না। এমনকি ভাসুরের নামও না। আমি এক পরিবারের কথা জানি, ঐ পরিবারে কোন নারী 'সাবান' কথাটি মুখে আনে না। তারা সাবানকে ফেনা বলে। কারণ ঐ পরিবারের বড় কর্তার নাম ছিল সাবান আলী। লোকটি অনেক আগেই মারা গেছে, কিন্তু বংশ-পরস্পরায় সাবান তাদের কাছে ফেনা হিসাবেই পরিচিত। পুরুষ কর্তৃক নারীকে দমনের এর চেয়ে জঘন্য উদাহরণ সম্ভবত আর হতে পারে না।
প্রথা অনুসারে বাবা পরিবারে কর্তা। এমনকি সন্তান-সন্ততির ওপর তার অধিকার ষোল আনা। ফলে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক গোটা পরিবার তার স্বেচ্ছাচারিতাকে মেনে নিতে হয়। পরিবারে এই পুরুষতান্ত্রিক আবহের দরুন শিশু এবং নারী অবদমনের শিকার হয় বেশি। একটি শিশুর মানস গঠনেঅবদমন যে কত ভয়ঙ্কর তা বলাই বাহুল্য। শিশুকে অবশ্যই বাধাহীনভাবে বাড়তে দিতে হয়, তবেই সে সমস্ত শক্তি নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, কাজেই ব্যক্তি পরিবারের হয়েও সমাজের বাসিন্দা। আর এই সমাজও নানান সংস্কার ও প্রথাজালে আবদ্ধ। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের মনুষ্যসমাজ তো কুসংস্কার এবং কুপ্রথার আখড়া। জাত-পাত, বর্ণবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, ফতোয়া ইত্যাদি দ্বারা ব্যাক্তি অহরহ নির্যাতিত হয়ে চলছে। এখানেও নানাবিধ কুসংস্কারের সবচেয়ে বেশি শিকার নারী। সমাজে কেবল নারীকে দমন করার উদ্দেশ্যেই যুগের পর যুগ ধরে নানান সংস্কার সংরণ হচ্ছে। 'লজ্জাই নারীর ভূষণ' এই প্রবাদটি নারী দমনের একটি যুৎসই অস্ত্র বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। লজ্জা নারীর ভূষণ নয় বরং আত্মঘাতী আয়ুধ। এই লজ্জার জন্যই নারী পরিবারর থেকে কিংবা সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে সর্বণ। সেজন্য তার ভিতর গতি শক্তির স্ফুরণ ঘটে সামান্যই। শুধু তৃণমূল সমাজেই নারী নিগৃহীত নয়, সে শিতি সমাজেও নির্যাতিত। চাকরিজীবি নারীর যে কত সমস্যা এর কোন হিসেব নেই। পর্দাপ্রথা, যৌতুকপ্রথা, পরপুরুষসংশ্রবে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সন্দেহ ইত্যাদি নানাভাবে স্ত্রী দমন-পীড়নের শিকার। অবদমন যে কেবল শিশু এবং নারীর ক্ষেত্র ঘটে তা নয়। সর্বস্তরের মানুষ ও ব্যাধিতে কম-বেশি সংক্রমিত। মানুষ জন্মসূত্রে অপরাধপ্রবণ নয়, বরং সমাজ-সংসারের নানা নিয়মশৃংখলের অবদমনের ফলে তার ইচ্ছাগুলোকে চেপে রাখতে গিয়ে, একসময় সে শিকারগ্রস্ত হয় কিংবা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। কাজেই বিভিন্ন সামাজিক অনুশাসন এ ধরনের অবদমনের জন্য দায়ী।
সমাজে সবল কর্তৃক দুর্বলেদের ওপর দমন তো নিয়তি-নির্ধারিত। আশরাফ-আতরাফ, বড়লোক-ছোটলোক ইত্যাদি কল্পিত বিভাজন সমাজে দুরারোগ্য ব্যাধি। এ ধরনের বিভাজনের মধ্য দিয়েই মতাবানেরা মতাহীনদের চিরদিন শাসন-শোষণ করে আসছে। সমাজের মতাবানরা ধর্মকে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার করে মতাহীনদের দমন-পীড়ন করে থাকে। এ আরেক ভয়ানক সংকট। মানুষ কোনোনা কোনো একটা ধর্মীয় বিশ্বাসের অন্তর্ভূক্ত। এই বিশ্বাসের কাছে সে দুর্বল। এই সুযোগটাকে মতাবানরা তাদের পে ব্যবহার করে সমাজে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সর্বণ ব্যাপ্রিত থাকে। এক অর্থে সংস্কার থেকে সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতি হল সভ্যতার বাহন। 'সভ্যতার সংঘাত' নামে বর্তমানে পাশ্চাত্যের যে হিংসাত্মক তত্ত্ব বিশ্বসমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে, এর মূল কথা হল পাশ্চাত্যের সবকিছুই ভালো, সুতরাং পৃথিবীকে শাসন করার অধিকার কেবল তাদেরই। কত ভয়ানক কথা! সাংস্কৃতিক দমন যে কেবল সভ্যতার সাথে সভ্যতার সংঘাত হিসেবেই ফলে এমন নয়। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, পরিবারে পরিবারে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, সমাজে এর প্রভাব সমানভাবে। যেমন-
কোনো ব্যক্তির তার বাহারি পোশাক বা নিদেনপে একটা দামী পারফিউম ব্যবহার
করেও অন্যের কাছে নিজেকে অসাধারণ প্রমাণের মাধ্যমে এক ধরনের সূক্ষ্ণ
দমনপ্রক্রিয়া চালাতে পারে। এরকমভাবে মানুষ তার পরিবারকে নিয়ে অহষ্কার করে। গোষ্ঠী বা বংশেও অহষ্কার করে। সে জন্যে মানুষ তার নামের সাথে বিভিন্ন খেতাব টাইটেল সংযুক্ত করে রাখে। যেমন- তালুকদার, চৌধুরী, খান, পাঠান, সৈয়দ, চক্রবর্তী, ব্যানার্জি, চ্যাটার্জি ইত্যাদি নানা কিশিমের টাইটেল। তেমনি
আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার যে আইন রয়েছে তাও তো সমকালীন ও সংশ্লিষ্ট সমাজের
নানান সংস্কার ও প্রথার ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাচীন ব্যবিলনীয় আইন (হাম্বুরাবির আইন) ও প্রাচীন রোমান আইনগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে এ সত্য অনুধাবন কোনো কঠিন বিষয় নয়। যেগুলো ছিল দাস শাসনের নামে কেবলি নিবর্তনমূলক, একতরফা । সেই ধারাবারিকতা এখনও চলছে, রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যক্তির ওপর শাসন, শোষণ, এ্যাকশন, দমন-পীড়ন ইত্যাদি নানা মাত্রায় এবং নানা পদ্ধতিতে। পরিশেষে বলব দমন-অবদমন নয় বরং আমাদের বুদ্ধিকে সকল কুসংস্কার এবং কুপ্রথার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে হবে আগে। অতঃপর আমাদের সামনে বিজ্ঞান-ভিত্তিক চিন্তার পথকে সুগম করে দিতে হবে। বিশ্বাসকে নয় যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এপথেই সর্বস্তরের মানুষের মুক্তি নিশ্চিত হতে পারে।