পাহাড়ি কন্যা

undefined

আবুল কাইয়ুম আহম্মদ : একটা মানুষের চেহারা, যদি হয় অপূর্ব লাবণ্যের প্রতীক, আর সে মানুষটা যদি হয় নারী, তাহলে তো মহাভাগ্যবতী! আবার মাঝে মাঝে সে লাবণ্যময়ী চেহারা নারীর জীবনে ভয়ে আনে কালো অধ্যায়আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে আমি তেমনি একজন আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী মেয়েপাহাড় থেকে সমতল ভূমিতে আমি কখনো আসিনিপরিবারের দুঃখ কষ্টের দিকে তাকিয়ে একটা এনজিওতে শিক্ষক কার্যক্রমে চাকুরী নিইশৈশবে আমার দিনগুলো কেটেছে নাচ গান আনন্দ উসবে স্বতঃর্স্ফুত ভাবে অংশগ্রহণ করেপাহাড়ি মেয়ে তাই পাহাড়কে আমি মন-প্রাণ উজাড় করে প্রেমিক হিসেবে বুকে স্থান দিয়েছিপাহাড়ের ঝর্ণায় অবাধ সাতার কেটেছিঅরণ্যের ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছি, সেই মালা কুপায় বেধে ছিমুই পাইংখইং তম্রইং ম্রইং
অক্যোয়াইংরোহ থংমা হিয়াহলেগান গেয়ে আনন্দে নেচেছিসেই দিনগুলোর কথা স্মৃতিপটে মনে হলেই চোখ হয়ে যায় অশ্রু নদী, হৃদয় হয়ে যায় তবিত, তখন সুখ ছিল আদিবাসী গ্রামেঅন্যরকম সুখছোট ছোট গ্রাম, ছোট ছোট সুখতখন সমাজে শোষণ বঞ্চনা ছিলনাশোষণ বঞ্চনার অর্থই আমরা জানতাম না। মানুষকে অবিশ্বাস, সন্দেহ করা তো চিরকাল পাপ বলেই জেনেছি, আর সারা জীবন ঠকেছি সন্দেহীনতার জন্যকিন্তু আজ অরণ্য নেই, আদিবাসীদের সে জীবনও নেইপাহাড় ঠিকই আছে, কিন্তু পাহাড়ের ওপর আমাদের অধিকার নেইসব হারিয়ে আজ আমরা অসহায়, বিপন্নহঠা সমতল ভূমির হায়েনারা এসে আমার প্রেমিক পাহাড়কে ছিনতাই করে নিয়ে গেলআমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল পাহাড়ের ভেতর যখন বাইরের মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটে তখন পাহাড়ি জীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্তকেননা ভালোবেসে, ভালো মন নিয়ে তো আসেনি পাহাড় দেশে কোনো বাইরের লোকআমি খুব কষ্ট করে আইএ পাশ করিআমার পরিবারের সবাই অশিক্ষিতআমরা খুবই গরীববাবা ভ্যান চালকচাকুরী নেবার আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল আদিবাসী মেয়েদের অগ্রাধিকার ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবেকিন্তু চাকুরি নিয়ে দেখি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তগুলোর একটাও মানা হচ্ছে নাচাকুরিতে কত ট্রেনিং করেছি, ট্রেইনার কত ভালো ভালো কথা বলেছে- কিন্তু সেগুলো ছিল কথার ফুলঝুরি মাত্র
চাকুরি নিয়ে আমাদের সংসারের কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে, কিন্তু আমার হৃদয় তবিত করে দিয়েছে তথাকথিত শিতি মুখোশধারীরাঅফিসে সুযোগ পেলেই বাঙ্গালি বড়কর্তা, ছোট কর্তা এমনকী আমার সহকর্মীরা বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করতওরা মুখে মানবাধিকারের কথা বলতনারীর মতায়ন, আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলতকিন্তু মনে প্রাণে ওরা ছিল ওসবের বিরুদ্ধেএকদিন শুনলাম ময়মনসিংহ থেকে একজন বাঙালী মুসলমান আমাদের অফিসে বদলি হয়ে আসছেনভয়ে আরো আতংকিত হলামযথা সময়ে সে আসলতাঁর কথা বার্তা চালচলনে আমি অবাক হলামএকদিন অফিসে মিটিং হচ্ছেবস আমাকে বললেন, তুমি বেলালকে নিয়ে ষ্টোর রুম থেকে বই নিয়ে এসআমি না বললামএকে একে আরো কয়েক জনের নাম বলল, আমি না উত্তরই দিলামবস হঠা রাগে বললেন- তাহলে ময়মনসিংগ্যা মদনটার সঙ্গে যাবেআমি হ্যাঁ বললামদুজনে ষ্টোর রুমে ঢুকলামপ্রায় এক ঘন্টা খুঁজে বই পেলামকিন্তু বসের সেই ময়মনসিংগ্যা মদনটার কাছ থেকে সেদিন যে ব্যবহার পেয়েছি, মনে হল ও যে দ্বিতীয় ভগবান বৌদ্ধভগবান বৌদ্ধের মতোই ছিল দাদার স্বভাবআমার একদম বিশ্বাস হতো না তিনি বাঙালিআমাকে সবসময় ছায়ার মতো আগলে রাখতেনতার সততা ও বিশ্বস্তায় আমি মুগ্ধ হয়েছিতিনি প্রায়ই বলতেন- মানুষের মৃত্যু আমাকে আঘাত করে না, কিন্তু মনুষ্যত্বের মৃত্যুকে আমি সইতে পারি নাহঠা একদিন বলে ফেললাম -এটা কী অপনার মতামতদাদা বললেন-শর বাবুরদাদা কম কথা বলতে ভালবাসেচিকার চেচাঁমেচি একদম পছন্দ করেন নাতিনি আবার মাঝে মাধ্যে গুন গুন করে গান গায়গানের স্বর খুবই মিষ্টিপুরোটা গেয়ে কখনও শেষ করেন নাওই টুকু শুনলেই মন হারিয়ে যায় কোন অজানা দ্বীপেএকদিন দাদাকে বললাম আপনি কি শিল্পী ?  তিনি কিছুণ চুপ থাকলেনতারপর হঠা ও নদীরে একটি কথা ............মনে হলো হেমন্তের গানআমি যেন জুবুযুবু হয়ে দাঁড়িয়ে অজর ধারায় বৃষ্টির পানিতে সাংগু নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছিকয়েকটা লাইন গাওয়ার পর থেমে গিয়ে বললেন- গাইবা, সময় হলো
 প্রায়ই অফিসের কার্যক্রম দেখে আমার কষ্টে চোখ ফেটে জল আসতোমনে মনে ভাবতাম- আদিবাসীদের নিয়ে সরকারের প্রতারণা দেখেছিএবার দেখলাম এনজিওদের প্রতারণাএকদিন খবর আসলো আমার বাবা ভীষণ অসুস্থবসের কাছে এসে ছুটি চাইলামবাবার অসুস্থার কথা বললাম, কিন্তু তিনি ছুটি দেননিময়মনসিংগ্যা দাদাটা অসুস্থতার কথা শুনে সাথে সাথেই বান্দরবান চলে গেলনিজের টাকা খরচ করে আমার বাবাকে সুস্থ করে তুললআমি বিষয়টা হেড অফিসকে জানালামতার কিছুই হলনাবরং হেড অফিস সেই বসকে প্রমোশন দিলএবার আরেক নতুন বস আসলতার ব্যবহারে মনে হল জলন্ত আগুন থেকে মুক্ত হয়ে ফুটন্ত কড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গেলামআমার দিকে যখন চাইত তখন মনে হতো আমার সারা শরীর গিলে খেতে চায় ? আমাকে অনেক উক্ত্যক্ত করতে লাগলহেড অফিসের নিয়ম আছে মেয়েদের মাসিকের সময় ফিল্ডে কাজ নিষিদ্ধকিন্তু সে সময় আমাকে ফিল্ডে কাজ করতে হতোঅফিসে পাঁচটার পর কাজ নিষিদ্ধ ছিলকিন্তু কাজ থাকুক কিংবা না থাকুক দশটা পর্যন্ত অফিসে বসিয়ে রাখতেন
ময়মনসিংগ্যা দাদা এ সবের প্রতিবাদ করায় একদিন তার চাকুরী চলে গেলআমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লামকী করবো বুঝে উঠতে পারলাম নাদাদাকে মোবাইল করলাম দাদা চাকুরী ছাড়তে নিষেধ করলআমার বাবা আবার অসুস্থ হলছুটি চাইলামবস আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করলোআমি রিজাইন লেটার লিখে বান্দরবান চলে এলামএসে দেখি বাবার লাশ উঠানে, সেখানে অনেক মানুষের ভীড়অবাক চোখে চেয়ে দেখলাম ময়মনসিংগ্যা দাদাটা নির্বাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে বাবার লাশ পাহারা দিচ্ছে
বেশ কয়েকদিন ধরে দাদাকে নিয়ে গ্রামে কথা উঠতে থাকলোএমননিতেই এক করুন হতাশার ঝড় বইছে বুকের ভেতরতাই এসব কথাবার্তার কোনো পাত্তা দিলাম নাএকদিন সকালে অবসন্ন শরীর নিয়ে হাঁটছিতখনও সূর্য উঠেনিরাস্তায় লোকজনের চলাচল কমআমাদের বাড়িটি তখনও জেড়ে উঠেনিহঠা চেয়ে দেখি গ্রামের রোয়াজা (গ্রাম প্রধান) আমাকে বলছেন - বুলবুলি তুমি আত্ম মর্যাদা বলে কিচুই কী শিখনি? তোমার বাবা তোমাকে কি শিা দিয়েগেছেনসবই কী ব্যর্থ ? সমাজের কাছে আমি কী জবাব দেব ? লজ্জা করে না বাঙালি মুসলমানকে বাড়ীতে রাখতে? আমি চোখ বন্ধ করে বিনম্রভাবে বললাম - সে ও যে মানুষভগবান বৌদ্ধের কাছে জাত ধর্ম বলে কিছুই নেইপাশেই দাঁড়িয়ে ছিল বাবার বন্ধু জিতু কাকুতিনি আমাদের ধর্মীয় ভিক্ষুবাবার সংগে তাঁর ছিল ভীষন ভাবসবাই তাকে সম্মান করেতিনি বললেন আমাদের ধর্ম আছে, মান আছে, জাত আছে, নাই শুধু মানুষের ভালবাসানাই শুধু দিব্য চোখযা দিয়ে তুমি বাস্তব পৃথিবীকে দেখতে পারসত্যকে মেনে নিতে পারোহ্যাঁ তোমার দাদা যদি তিনটি কাজ করতে পারে তাহলে তোমার দাদাকে মুক্তি দেব
আমি বললাম - কী কাজ ?
তিনি বললেন প্রথম কাজ হল আগামীতে যে সাংগ্রাই উসব হবে, আজ থেকে চাঁদা উঠানো হবেযে যত টাকা দেবে টাকার নম্বর সহ আমি লিখে রাখবতারপর থলের ভেতর নম্বর সহ টাকা গুলো পেকেট করে বাবুর নিকট জমা রাখা হবেকোন ভাবেই বলা যাবে না থলে নম্বর সহ টাকা আছেসেই থলে তিন মাস পর ফেরত চাইবটাকা সহ থলে ফেরত দিলে মনে করবো তিনি মানুষ
তারপর সব গুলো টাকার নম্বর এক এক করে মেলাবো, টাকার নম্বর মিললে মনে করবো তিনি মানুষের মধ্যে ভালোদ্বিতীয় পরীাটা হবে - সাংগ্রাই অনুষ্ঠানে আমাদের ভাষার তিনটি ও তাদের ভাষার তিনটি তিনটি করে মোট ছয়টা গান গাইতে হবেতিন নম্বর পরীক্ষাটা খুব বিপদজনকসেটা হল আগামী নবান্ন উসবে আমাদের সম্প্রদায়ের ২১ জন গানের এবং নাচের শিল্পীকে নিয়ে দূর্গাপুর বিরিশিরি কালাচারাল একাডেমীতে যেতে হবেসংগে শুধু বাবু যাবেনওই পরীক্ষা গুলোতে উর্ত্তীণ হতে পারলেই তোমার দাদাবাবু কে আমরা স্বসম্মানে মুক্তিদেবমনে রেখ - এ ব্যাপারে বাবুর সংগে তোমার কোন গোপন কথা চলবেনাআজ থেকে তোমার পেছনে আমাদের কড়া নজর থাকবে
আমি ভাবতাম - দাদা বাবু সব কাজই পারবেন কিন্তু আদিবাসী গান গাইতে পারবেন নাকারণ তার মুখে তো কখনও আদিবাসী গান শুনিনিআর আমার ভয় বাড়তে থাকলোদাদা কী পারবে ? এরই মধ্যে সাংগ্রাই অনুষ্ঠান এসে গেলসবার মধ্যে একটা আনন্দ উদ্দিপনার ভাব দেখা গেলচমকার ভাবে সাজানো হল মঞ্চ, আধুনিক আলোকসজ্জাআমি কোন মতে ভয়ে ভয়ে মাঝামাঝি জায়গায় একটা আসনে বসে গেলামদাদা তিনটা আদিবাসী গান গাইলেনদাদার গান শেষ হতেই লোকজনের চেঁচামেচি ওয়ান মোর, ওয়ান মোরতারপর অদ্ভুত সুন্দর করে গাইলেন বাঙালি তিনটা গানআবার চেঁচামেচি ওয়ান মোর, ওয়ান মোরদাদা আর গাইলেন নাওদিকে সাংগ্রাই অনুষ্ঠানের পুরো টাকা তিনমাসে দাদার কাছে যেভাবে রাখাহয়েছিল ঠিক সেইভাবে আমাদের সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধেয় দায়িত্বপ্রাপ্তগন পেয়েছিলআর ওদিকে আমার চোখে মুখে এক অজানা আনন্দ ছড়িয়ে পড়তে থাকল
আমাদের গ্রামে আরেক উসবের আরেক আমেজ শুরু হল২১ জন মেয়ের রিহার্সালঅর্ধেক সময় ধরে চলে যন্ত্রসংগীতবাকি অর্ধেক সময় গান, নির্বাচিত ধরনের গানহঠা চেয়ে দেখি এক অদ্ভুত মোহনীয় সুরে একাত্ম হয়ে ওঠেছে গোটা পাহাড়ের প্রকৃতিতারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো মানুষ আসতে থাকলএখন পাহাড়ে সবার মুখে মুখে দাদার প্রশংসাতবে কয়েকজন বলাবলি করছে শুধু একজন বাঙালির ওপর ২১ জন আদিবাসী মেয়েকে ছেড়ে দেয়া যাবেনাদাদা এবারও উত্তীর্ণ হলেনবিরিশিরি থেকে প্রোগ্রাম করে সবাই ভালোভাবে এসেছেগোপনে ২১ জনের সাক্ষাকার নেয়া হলসবাই বলল - তিনি দ্বিতীয় গৌতম বৌদ্ধসবার ভুল ভাঙ্গলএবার দাদার জন্ম দিবস পালন করতে চাইলামদাদা জন্মতারিখ বললেন না বরং তা পালন করতে নিষেধ করলেনআমি খুব কষ্ট করে দাদার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ২ জানুয়ারী তা পালনের সিদ্ধান্ত নিইসন্ধ্যায় কেককাটার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হলআমাদের সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য আদিবাসীরাও আসলোপুরো বাড়ি কানায় কানায় ভরে গেলমানুষ শুধু বলতে থাকল গৌতম বৌদ্ধ না কি জীবন্ত হয়ে এসেছে ? এবার দাদাকে একটা গান গাইতে বললাম- দাদা সংগে সংগে গাইলেন-
একটি বীণাতার একটি সংসার
ভায়ের আদরের ছোট বোন.....
গানটি শেষ হতে না হতেই দাদা রক্ত বমি করতে করতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেনকী করুণ হয়ে উঠল চারপাশচারিদিকে জোছনা প্লাবিত কান্না ঝরানো রহস্যময় প্রকৃতি আমাকে আজীবনের জন্য স্তব্দ করে দিয়ে গেল

 
Design by নেত্রকোনার আলো | সম্পাদক - সোহেল রেজা | Email-netrakonaralo@gmail.com