নেত্রকোনার লোকজ সংস্কৃতি, বিলুপ্ত প্রায় পূর্ব বাংলার ঘাটু গান


আবুল কাইয়ুম আহম্মদ : সুর, তাল, লয়সহ মনের ভাব প্রকাশ করাকেই গান বলেগানের বহু প্রকারভেদ আছেযেমন ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্‌পা, ঠুমুরী, গজল, কাওয়ালী, বাউল, ভাটিয়ালী, কীর্ত্তন ইত্যাদিএ গুলোর মধ্যে ঘাটু গান বাংলার লোকসংগীতের জনপ্রিয় ধারা হিসেবে তার অস্তিত্ব দৃঢ়ভাবে বজায় রেখেছিলএই ঘাটু গান দিন দিন তার জৌলুস হারাচ্ছে বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকেমূলত এই গান ছিল নিভৃত গ্রামের গানএক শ্রেনীর মোহনীয় বালককে কেন্দ্র
করে গড়ে ওঠা গানকে ঘাটু গান বলা হয়ধারণা করা হয় ঘাট থেকেই ঘাটু শব্দের উপত্তিভাটি এলাকায় এই গানের প্রসার ঘটেবিশেষত পূর্ব ময়মনসিংহ তথা নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও বৃহত্তর সিলেটের হাওরে এই গান গড়ে উঠেছিলপরবর্তীতে এই ঘাটু গান বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভালুকা, মুক্তাগাছা, গৌরিপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, ধোবাউরা, কিশোরগঞ্জ, করিমগঞ্জ, নিকলী, ইটনা, তাড়াইল, হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, কটিয়াদি, ভৈরব, নরসিংদীর বেলাবো,নেত্রকোনার, পূর্বধলা, কেন্দুয়া, আটপাড়া, বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুরী, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লায় ওই গানের আসর জমতো
নদী বিধৌত ওই জনপদে আমাদের জীবনের একটা বিরাট অংশ জুড়েই রয়েছে নদীর অবস্থাননদী এবং আমাদের হৃদয়মন কবে যে একাত্ম হয়ে গিয়েছে তা জানি নাতাই আমাদের জীবন, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের আবেগ ও নিত্যদিনের হাসি-কান্নার গাল-গল্প ওই নদীকে কেন্দ্র করেইবর্ষাকালে নদীর পানি হয় টুইটুম্বুরসারা হাওর অঞ্চল ভরে যায় পানিতেবর্ষায় হাওরে মানুষের কাজ থাকে নাতখন হাওরের মানুষেরা হয়ে যায় আবেগপূর্ণসেই আবেগকে কেন্দ্র করেই নৌকার পাটাতনের উপর ঘাটু গানের জমজমাট আসর বসতএক শ্রেনীর কিশোর বালককে নাচে-গানে পরিপূর্ণ করে ঘাটু বালকে পরিণত করে তারপর সেই নৌকা বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে ভিড়িয়ে ওই গান পরিবেশন করা হতঘাটু গানের বিলন্বিত সংগীতাংশের সাথে শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ গানের একটা মিল রয়েছেদু'টি গানেরই ভাষা প্রায় একইউভয় গানই সাধারণ গ্রামের গানঘাটু গানের তাল কোন নিয়মের মধ্যে বাঁধা নেইঘাটু গানের সুর কোন একক মানুষের সৃষ্টি নয়, এগুলো বাংলার শাশ্বত পলির উর্বর মাটি থেকে উঠে আসা এক লোকাতীত সুরঘাটুর গাওয়া একটা গানের বিরহ-বর্ণনা দেওয়া হল:

" আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে, শ্যাম বিনোদিয়া
মাতা ছাড়লাম পিতারে ছাড়লাম
ছাড়লাম সোনার পুরী,
তোমার লাইগা পাগল হইয়া দেশ-বিদেশে ঘুরি
আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে, শ্যাম বিনোদিয়া
আগে যদি জানতামরে বন্ধু যাইবারে ছাড়িয়া
দুই চরণ বান্দিয়া রাখতাম মাথার কেশ দিয়া
আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে, শ্যাম বিনোদিয়া.....।"

এক সময় ঘাটুর ভরণপোষণ করা বিশেষ ঐতিহ্যশালী ব্যাপার মনে করা হতো, যে গ্রামে কোন ঘাটু রাখা হতো না, সে গ্রামের কোন সামাজিক কদরও থাকতো নাওই ঘাটুর জন্য জমা-জমি বিক্রি করে কেউ পথের ফকির পর্যন্ত হয়েছেআবার কেউ কেউ স্ত্রী, সন্তান ত্যাগ করে ঘাটুকে নিয়ে জীবন কাটানোর ঘটনাও ঘটেছেওই ঘাটুকে কেন্দ্র করে অনেক সংসার পর্যন্ত ভেঙ্গে গেছেওই ঘাটুকে নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা, সমালোচনা এখনো পল্লী সমাজে বিরাজমান
ঘাটুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গ্রাম্য মারামারি মামলা-মেকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছেএসব খবরাখবর তখনকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছেদুঃখজনক হলেও সত্য এই সুন্দর শিল্পকে বর্তমান কালের কিছু শিক্ষিত মানুষ অশ্লীল বলে মনে করেনতাদের এই ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়বর্তমানে ঘাটু গান অশ্লীল হলেও ওই সময়ে বাংলার পল্লীর মানুষ সাংস্কৃতির একটা দিক হিসেবেই ক্ষণিকের জন্য হলেও আবেগে হারিয়ে যেত কোন এক অজানা দ্বীপেলোকসংগীতের হারিয়ে যাওয়া এ ধারাটিকে তার বিশিষ্ট অবস্থানে ফিরে আনলে বাঙ্গালি সংস্কৃতি আরো প্রানবন্ত হবে
          
লিখেছেন  : আবুল কাইয়ুম আহম্মদ (শিক্ষক)
মোবাইল  : ০১৭১৬-৩৪৯৭২৪
 
Design by নেত্রকোনার আলো | সম্পাদক - সোহেল রেজা | Email-netrakonaralo@gmail.com