নিজেকে একটা দ্বীপের ভেতর মনে হয় । কুলের শিশুরা, পরিচিত সঙ্গিহীন রাস্ত, আর নিজের বাড়ি এইটুকুই। আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু,চারপাশের
জগৎ, রাজনৈতিক পরিবেশ সব কিছুই যেন বাইরের এক জগতে, জয়া যেন অবরূদ্ব একাকী এই দ্বীপে, সমাজর মানুষের কাছে সে বেমানান । মনে হয় জয়াকে সবাই করুনা করছে যুদ্বে হেরে যাওয়া বীরকে যেমন করে, কিংবা অহংকারীর অহংকার চুর্ণ হলে যে চোখে তাকায় সবাই!
জগৎ, রাজনৈতিক পরিবেশ সব কিছুই যেন বাইরের এক জগতে, জয়া যেন অবরূদ্ব একাকী এই দ্বীপে, সমাজর মানুষের কাছে সে বেমানান । মনে হয় জয়াকে সবাই করুনা করছে যুদ্বে হেরে যাওয়া বীরকে যেমন করে, কিংবা অহংকারীর অহংকার চুর্ণ হলে যে চোখে তাকায় সবাই!
জয়ার পৃথিবীতে একজন সুনন্দ আছে, বাইরের দরজায় দাড়িয়ে থাকা এক আগন্তকের মতো খোলসের ভিতর গুটিয়ে থাকা এক তাপস প্রেমিক। জয়ার সমস্ত ক্লান্তি, দুঃখ, কষ্ট গ্লানিকে মুছে দিতে চায় যে, পৃথিবীর সব বাধা, সব নিয়মের শৃঙ্খল ভেঙ্গে আলোর পথে নিয়ে যেতে চায় । কিন্তু জয়া ? তার হাত ধরবে কেন? কিংবা কাউকে কাছে চাইবার, বন্ধু ভাবার অধিকার তার নেই বলে? সতীত্ব, বিয়ের আমরণ বন্ধন, এমন সব ঘাতক লৌকিক সংস্কারের কাছে জয়া কি তবে আত্মাহুতি দেবে ?
বিষয়গুলি জয়াকে হাসায় এবং ভাবায়, জয়াকে দৃঢ় করে আবার নিরাক্ষাশ করে তবে নিরাশ হয় কম, কেননা-এ সমাজে তো তাই প্রাপ্য নারীর। এখানে নারীকে ভোগ্য পণ্য হতে হবে, পুরূষ তার প্রতি লালায়িত থাকবে, তার কাছ থেকে আশা করবে সেবা, র্কতৃত্বহীনতা আর অসহায়ত্ব, কেউ আবার দেবীর মতো পূজা করবে, মাথায় তুলে নিয়ে বির্সজন্ও দিবে।
পথে যেতে যেতে শ্যামাদির কথা মনে হয় -শক্ত নিটোল গড়নের ব্যক্তিত্বময় নারী, বিয়ে হয়নি, হবেনা হয়তো। শ্যামাদি একদিন বলছিল-কিসে ভয় বলো ? বিকেলে একটু ক্যাম্পাসে হাঁটা, বেশী রাত জাগা-তাতে সমালোচনা, আমাকে দেখে কেন শিষ দেয় তাতেও আমার দোষ। সবকিছুই যখন দোষের, নিজের স্বাভাবিক চলার গতি থামাবো কেন বলো? তারপরও কেমন করে কাটে শ্যামাদির সময়টকু?
স্বামী, সংসার, ছেলেমেয়ে এর বাইরে নারীদের জীবন এমন ভয়ংকর দ্বীপের মতো কেন ? সবাইএমন সৃষ্টিছাড়া ভাব করে কেন ?
জয়া পড়েছে অনেক নারীর জীবনী - যারা সংসারের বাইরেও সেরা মানুষ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিখ্যাত নারীদের জীবনী পড়লে নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বা খোলসের ভেতরের প্রাণি মনে হয়না ।
কিন্তু কতক্ষণ ? তারপর আবার অন্ধকারে হেঁটে চলা । সমাজের সব ঘৃণা , সব যন্ত্রণা যেন আকড়ে ধরে তাকে, এ থেকে মুক্তি নেই যেন !
খোলসের ভেতর প্রাণিগুলোকে দেখে জয়া, দিব্যি বেঁচে আছে নিজের ভেতর নিজেকে বাঁচিয়ে ।
সীমা পাগলী, সে আছে নিজের ভেতর সগৌরবে ,নিজের চিৎকারে নিজেরই দাপটে কেউ থেমে নেই,কিছু থেমে থাকেনা ।
তবু কারো কারো জীবন কিছু সময়ের জন্য থেমে যায় বৈকি! জয়া হাটছে একা একা । প্রতিদিন স্কুলের পথটুকু একা একাই হাটতে হয় ,ফেরার পথে অনেকটা রিক্সায় আসলেও দুই মাইল তাকে হাটতে হয়, পথটুকু যেতে যেতে পথের দাবিটুকু মিটিয়ে বাকী সময়টা তাকে কিছু না কিছু ভাবতেই হয় ; টুকরো টুকরো আর এলোমেলো হয় সে ভাবনাগুলো ।জীবনের লক্ষ্য নিয়ে নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার দ্বন্ধ সংঘাত এই পথেই হয় । হাটার ক্লান্তিটুকু তাতে যেন কমে আসে ।তারপর সমাজ - সংস্কতি আর প্রকৃতির ভাবনা । মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে মায়কোভস্কি,পাবলো নেরুদার কবিতা আবৃতি করা । ত্রিশ বছরের নারীর ইচ্ছে হলেই কবিতা আবৃতি কি মানায় ? তাই এইসুযোগ -ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলার এই জনহীন পথ ।
কখনো প্রিয় কবি সুকান্ত’র-–নবজাতকের কাছে এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার দৃঢ় অঙ্গীকার । হেমাঙ্গ বিশ্বাসের -দুঃখে দুঃখে চম্পার পলাশ হওয়ার কাহিনী অথবা দিগন্তের মেঘে মেঘে অগ্নিপাটের ঝলমলে দুরন্ত ইঙ্গিত খোঁজা ।
কবিতা যদি মানুষের জন্য হয়, সাহিত্য যদি মানুষের জন্য হয় ,তবে যে মানুষেরা তাদের প্রাচীন চাহিদা মেটাতে পারেনা, দাস জীবন যাপন করতে হয় যে সমাজে , সে সমাজ পরির্বতনে কবিতার ভুমিকা বলিষ্ট থাকা চাই । কাস্তেটা শাণ বন্ধু ! কিংবা- –বন্দুকের নল কি করে ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠে? -তেমন তথ্য সমৃদ্ব কবিতাই তাদের কাছে ঝলসানো রুটি। এ সময়ের শ্রেষ্ট সাহিত্যের দাবীদার ।
এমন সব ভাবনাই জয়ার পথের ক্লান্তি ঘোচায় ।পথ শেষ হয়ে যায়, ভাবনাগুলো রয়ে যায় কালের অপেক্ষায়।
শেষ বিকেলের সময়টুক আরও রহস্যময় , ক্লান্তিময় হয়ে আসে। ছাদে শুয়ে পাখিদের ঘরে ফেরা দেখা,নয়তো বাড়ির পেছনে ঘাসের নরম রোদে শরীর বিছিয়ে ঝাপসা চোখে সপ্ন খোঁজা, জয়া তখন হাঁপায়,আজকাল ভাবনাগুলি হয় ছেড়া ছেড়া,টুকরো টুকরো সুতার মত - কোনটার যেন শেষ নেই , আর সপ্নগুলির বর্তমান নেই, ভবিষ্যত নেই, শুধু আছে দুর অতীত।গতকালের ঘটনা এমনকি মূহূর্তের ঘটনাগুলিও যেন দুর অতীতের সাথে মিশে যায় ।
ভাবনাহীন সময়টা বোধহয় দ্রত ফুরায় । রুটিনবিহীন জীবন তখন,সবেমাত্র নিজের ভেতর অন্যরকম করে জেগে উঠা ,নিজেকে জানার আনন্দ, ,চেনা সব নিয়ম শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলার দীপ্ত বাসনা, যনে যুগ যুগের শেকল ভাঙ্গা চন্ডী ।ক্লাসের বাইরে সাহিত্য পরিষদ,নাটকের মহড়া , বন্ধুদের সাথে আড্ডা,রাত জেগে পোস্টার করা, ব্যানার করা,নারী দিবসের র্যালি, ট্রাফিক মোড়ে বক্তৃতা, সারাবেলা সপ্নের হাতছানি, মুক্তির উল্লাস.........।